তরজমা: আমাদের সবার মধ্যে কি তারই উপর জিকর (অর্থাৎ মহান ঐশী বাণী) অবতীর্ণ করা হয়েছে? বরং এ তো জঘন্য মিথ্যাবাদী দাম্ভিক। তারা অতি শিঘ্রই আগামীকাল জেনে যাবে কে ছিলো বড় মিথ্যাবাদী, দাম্ভিক। আমি অবশ্যই উষ্ট্রী প্রেরণকারী তাদের পরীক্ষার জন্য। (সুতরাং ওহে সালেহ আলায়হিস্ সালাম) তুমি তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখ এবং ধৈর্যধারণ কর। এবং তাদেরকে সংবাদ দিয়ে দাও যে, পানি তাদের মধ্যে বন্টন করা হবে। প্রত্যেক অংশের উপর সে-্ই উপস্থিত হবে, যার পালা আসবে। অতঃপর তারা তাদের সঙ্গীকে ডাকলো। সে তাকে ধরল এবং বধ করল। অতঃপর কেমন হলো আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী? নিশ্চয় আমি (অর্থাৎ আল্লাহ পাক) তাদের উপর এক বিকট শব্দ প্রেরণ করেছি। তখন তারা পরিণত হলো পশুর ঘেরাও নির্মানকারীর অবশিষ্ট ঘাসের ন্যায় যা শুস্ক, পদ-দলিত ছিল। এবং নিশ্চয় আমি (অর্থাৎ আল্লাহ) কুরআন কে সহজ করেছি স্মরণ রাখার জন্য। সুতরাং কেউ স্মরণ রাখার আছে কি? লূত-সম্প্রদায়ের লোকেরা রাসূলগণকে অস্বীকার করেছে। নিশ্চয় আমি তাদের উপর পাথর বর্ষণ করেছি লুতের পরিবার বর্গ ব্যতীত। আমি তাদের কে শেষ প্রহরে রক্ষা করেছি। আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ স্বরূপ। আমি এভাবেই পুরস্কৃত করি তাকেই, যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এবং নিশ্চয় তিনি (অর্থাৎ হযরত লুত আলায়হিস্ সালাম) তাদেরকে আমার পাকড়াও সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। অতঃপর তারা ভীতির ফরমান গুলোতে সন্দেহ করেছে এবং তারা তাঁর নিকট (হযরত লুত আলায়হিস্ সালাম) এর নিকট তার মেহমানদেরকে ফুসলাতে চাইলো। তখন আমি আল্লাহ তাদের চোখগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিলাম। বললাম- আস্বাদন করো আমার শাস্তি এবং সতর্কবাণী। (সুরা আল ক্বামর-২৫ থেকে ৩৭ নং আয়াত)
আনুষঙ্গিক আলোচনা
أَأُلْقِيَ الذِّكْرُ عَلَيْهِ مِن بَيْنِنَا بَلْ هُوَ كَذَّابٌ أَشِرٌ
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন- উপরোক্ত আয়াতে বিবৃত হয়েছে-সামুদ সম্প্রদায় তাদের নবী সাইয়্যেদুনা হযরত সালেহ আলায়হিস্ সালামকে বড় মিথ্যাবাদী দাম্ভিক হিসাবে আখ্যায়িত করত: নবীর শানে চরম অবমাননা করেছে। যেহেতু তারা কাফির -বেঈমান ছিল।
সুরা হুদ এর সাতাশ নম্বর আয়াতে এরশাদ হয়েছে- فقال الملأ الذين كفروا من قومه ما نراك إلا بشرا مثلنا অর্থাৎ সাইয়্যেদুনা হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম-এর সম্প্রদায়ের কাফির সরদারগণ বললো আমরাতো আপনাকে আমাদের মত একজন মানুষ ব্যতীত আর কিছু মনে করিনা। (নাউজুবিল্লাহ) অত্র আয়াতের মর্মালোকেও প্রমাণিত হয় যে, হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম-এর সম্প্রদায়ের কাফির সরদারগণ তাঁর নবুওয়াত রেসালতকে অস্বীকার করে তাঁকে নিজেদের মত একজন মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করতঃ নবীর শানে-মর্যাদায় ভয়ংকর অবমাননা করেছে। যেহেতু তারা কাফির-মুশরেক ছিল।
সুরা ইয়াছিন এর ১৫ নম্বর আয়াতে এরশাদ হয়েছে- قالوا ما أنتم إلا بشر مثلنا وما أنزل الرحمن من شيء إن أنتم إلا تكذبون অর্থাৎ ইন্তাকিয়া (মুলকে শাম এর প্রাচীন গ্রাম) জনপদের বাসিন্দারা তাদের নিকট প্রেরিত রাসূলগণকে বললো-আপনারা তো আমাদের মতই মানুষ, দয়াময় আল্লাহ কিছুই নাযিল করেনি। আপনারা কেবল মিথ্যাই বলে যাচ্ছেন। অত্র আয়াতের ভাষ্যালোকেও প্রতিভাত হয় ইন্তাকিয়া নগরীর বাসিন্দারা তাদের নিকট প্রেরিত আল্লাহর রাসূলগণকে নিজেদের মত মানুষ বলে অভিহিত করে তাঁদের নবুওয়ত-রিসালতকে অস্বীকার করে আল্লাহর নবীর শানে-সম্মানে ভীষণ অপমান করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় মক্কার কাফির-মুশরিকরা আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠতম নবী দোজাহানের কান্ডারী আহমদ মুজতাবা মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে অস্বীকার করে উন্মাদ বলে অভিহিত করে চরম অপমান-অবমাননা করেছে। যেমন-এরশাদ হয়েছে- يا أيها الذي نزل عليه الذكر إنك لمجنون অর্থাৎ ওহে মহান স্বত্ত্বা! যার উপর কুরআন নাযিল করা হয়েছে। নিশ্চয় আপনি উন্মদ। নাউজুবিল্লাহ।
উপরোক্ত আয়াত সমূহের মর্মবাণীর আলোকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় এ বিষয়-সাইয়্যেদুনা হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম থেকে আরম্ভ করে আমাদের নবী ইমামুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম পর্যন্ত আল্লাহর প্রেরিত সকল নবী-রাসূলকে আপন আপন যুগে কাফির-মুশরিক বেঈমানরাই আমাদের মত মানুষ রূপে আখ্যায়িত করতঃ তাঁদের নবুওয়ত-রেসালাত কে অস্বীকার করে চরম অবমাননা করেছে। কখনো আল্লাহর নবী-রাসূলকে কাফের-মুশরিকরাই মিথ্যাবাদী, দাম্ভিক বা উন্মাদ বলে আহ্বান করে তাঁদের শানে বড় বেয়াদবি, ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে। যেহেতু তারা প্রকাশ্য বেঈমান-বিধর্মী ছিল। কোন কালে কোন নবী-রাসূলকে কোন মুমিন-মুসলমান আমাদের মত মানুষ বলে আখ্যায়িত করেনি। এটাই কুরআনে করিমের মর্মবাণীর আলোকে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সত্য। বরং সকল যুগের সকল মুমিন-মুসলিমের সুস্পষ্ট স্বীকৃতি ও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-তিনি রাসূলুল্লাহ, তিনি খলিফাতুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অর্থাৎ তিনি আল্লাহর প্রেরিত পরম প্রিয়তম রাসূল, নবী আর খলিফা, আল্লাহর পরে সকল সৃষ্টির সর্ব শীর্ষে তিনি মহিয়ান গরিয়ান, শ্রেষ্ঠতম,মহত্তম, চির সম্মানিত ও মহিমান্বিত স্বত্বা, তিনি অতুল-অনুপম এটাই প্রকৃত ও পরিপূর্ণ ঈমানের স্বরূপ, এটাই হেদায়ত। এর বিপরীতে আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলকে তাঁর নবুওয়ত-রেসালতের সুমহান মর্যাদার স্তর থেকে অবনমিত করা সুস্পষ্ট ও নিশ্চিত কুফরি আক্বিদা। যা ঈমান-ইসলাম বিধ্বংসী নিশ্চিত গোমরাহী। যা সকল যুগে সকল নবী-রাসূলের শানে প্রকাশ্য কাফির মুশরিকরা করে এসেছে। (নাউজুবিল্লাহ) মহান আল্লাহ সকল মুমিন-মুসলমানের ঈমান আকিদা হেফাজত করুন। আমীন।
إِنَّا مُرْسِلُو النَّاقَةِ فِتْنَةً لَّهُمْ فَارْتَقِبْهُمْ وَاصْطَبِرْ
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যায় কুরআনে করীমের তাফসীর বিশারদগণ উল্লেখ করেছেন-আলোচ্য আয়াতে আল্লাহর নবী হযরত সালেহ আলায়হিস সালামের নবুওয়ত-রেসালতের সত্যতার প্রমাণ স্বরূপ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরীত জীবন্ত উষ্ট্রীর বিষয় বর্ণিত হয়েছে।
হযরত সালেহ আলায়হিস সালাম প্রাচীন আদ জাতির দ্বিতীয় শাখা সামূদ সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর সম্প্রদায় সামুদ কে সর্বপ্রথম তাওহিদের প্রতি দাওয়াত দিয়েছিলেন। দেশবাসী তা প্রত্যাখ্যান করে বলল ‘এ পাহাড়ের প্রস্তরখন্ড থেকে আমাদের সম্মুখে আপনি যদি একটি জীবন্ত উষ্ট্রী বের করে দেখাতে পারেন, তাহলে আমরা আপনাকে সত্য নবী বলে মানতে রাজি আছি। হযরত সালেহ আলায়হিস্ সালাম তাদেরকে এ বলে সতর্ক করলেন যে,তোমাদের চাহিদা মোতাবেক মোজেযা প্রদর্শনের পরও যদি তোমরা ঈমান আনতে দ্বিধা করো, তাহলে কিন্তু আল্লাহর বিধান অনুসারে তোমাদের উপর আযাব নেমে আসবে। তোমরা সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে। এতদসত্ত্বেও তারা নিজেদের হঠকারিতা থেকে বিরত হল না। মহান আল্লাহ তাঁর অসীম কুদরতে তাদের চাহিদা মোতাবেক মুজেজা প্রকাশ করলেন। বিশাল প্রস্তরখন্ড বিদীর্ণ হয়ে তাদের কথিত গুণাবলি সম্পন্ন উষ্ট্রী আত্মপ্রকাশ করল। মহান আল্লাহ হুকুম দিলেন যে, এ উষ্ট্রীকে কেউ যেন কোন রূপ কষ্ট না দেয়। যদি এরূপ করা হয় তবে তোমাদের প্রতি আযাব নাযিল হয়ে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু তারা নিষেধাজ্ঞা আমান্য করল, উষ্ট্রী কে হত্যা করল। তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কঠোরভাবে পাকড়াও করলেন। সাইয়্যেদুনা হযরত সালেহ আলাইহিসসালাম ও তাঁর সঙ্গী-সাথী ও ঈমানদারগণ নিরাপদে রক্ষা পেলেন। অন্য সবাই এক ভয়াবহ গর্জনে ধ্বংস প্রাপ্ত হলো। নাউজুবিল্লাহ। এর প্রেক্ষিতে প্রমাণিত হলো যে, আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রতি সামান্যতম অবাধ্যতা প্রদর্শন কিংবা ন্যূনতম অবমাননা নিশ্চিত ধ্বংসের কারন। মহান আল্লাহ এরশাদ করলেন-وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآن لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِر অর্থাৎ অতঃপর কেমন কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী।” অর্থাৎ এত শক্তিশালী ও জনবহুল জাতির উপর যখন আযাব নেমে এলো তখন দেখ তারা কিভাবে মশা-মাছির ন্যায় নিপাত হয়ে গেল। এতদসঙ্গে মুমিন ও কাফিরদের উপদেশের জন্য এই বাক্যটিও অর্থাৎ বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর এই মহা শাস্তির কবল থেকে আত্মরক্ষার একমাত্র পথ হচ্ছে কুরআন। উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণের সীমা পর্যন্ত আমি কুরআন কে সহজ করে দিয়েছি। কাজেই সেই ব্যক্তিই চরম হতভাগা ও বঞ্চিত, যে কুরআন দ্বারা উপকৃত হয়না।
লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।