একসময় নিয়মিত ক্রিকেট খেলতেন। কিন্ত চোটের কারণে ছাড়তে হয় খেলা। তবে ক্রিকেট থেকে দূরে সরতে পারেননি। ক্রিকেট খেলা ছেড়ে এখন ক্রিকেটসামগ্রী তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছেন মো. জিয়াউল হক। সফল এই উদ্যোক্তাকে নিয়ে এবারের মূল প্রতিবেদন।
ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত ক্রিকেট খেলতেন মো. জিয়াউল হক। ইচ্ছে ছিল একসময় জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন। কিন্তু মাঝপথে চোটের কারণে তাঁর সেই স্বপ্ন হোঁচট খায়। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেলেও ক্রিকেটের সঙ্গ ছাড়েননি তিনি। চোটের কারণে খেলা ছেড়ে নাম লেখান উদ্যোক্তার খাতায়। ক্রিকেটের নানা উপকরণ তৈরি করেন তিনি।
বর্তমানে জিয়াউলের কারখানায় তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট ব্যাট, বল, গ্লাভস, প্যাডসহ কয়েক ধরনের পণ্য। এসব পণ্য তৈরি করছেন প্রায় অর্ধশত শ্রমিক। আর কারখানা স্থাপন ও পণ্য উৎপাদনে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন কয়েক কোটি টাকা। এই উদ্যোক্তা জানান, দেশে আমদানি করা ক্রিকেট পণ্যের তুলনায় ৪০ শতাংশ কম দামে তিনি পণ্য বিক্রি করেন। আর তাঁর কারখানার সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে এরই মধ্যে পেয়েছেন জাতীয় এসএমই পুরস্কার।
ক্রিকেটার থেকে উদ্যোক্তার হয়ে ওঠার গল্প তিনি সম্প্রতি শোনান। তিনি বলেন, ক্রিকেট খেলা ছিল আমার তীব্র আবেগের জায়গা। খেলোয়াড় হতে না পেরে তাই যেকোনো উপায়ে ক্রিকেটের সঙ্গে থাকতে চেয়েছি আমি। আর এ পথচলায় সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন আমার স্কুলশিক্ষক মা মোসাম্মত তাসলিমা খাতুন ও বাবা আলাউদ্দিন আহমেদ।
নিজের ডাকনামের সঙ্গে মিলিয়ে জিয়াউল তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম রেখেছেন তনিন স্পোর্টস বা টিএন স্পোর্টস। জিয়াউলের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলায়। আর তনিন স্পোর্টসের কারখানা সদরের রহিমানপুর ইউনিয়নে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতক পাস এই উদ্যোক্তা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়ছেন।
জিয়াউল হক জানান, ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট ছিল নেশার মতো। তবে ক্রিকেটের জন্য নিজেকে তৈরির প্রথম সুযোগ পান মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে। সেটা ২০০২ সালে। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে দ্বিতীয় দিনেই চলে যান দিনাজপুরে। উদ্দেশ্য সেখানকার আঞ্চলিক বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) থেকে ক্রিকেটের প্রশিক্ষণ নেওয়া। পাশাপাশি তিনি ভর্তি হন দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে।
মূলত খেলাধুলার সঙ্গে থাকতেই পলিটেকনিকে ভর্তি হন তিনি। সেখানে অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রথম দিকে দিনাজপুরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ক্রিকেট লিগে খেলা শুরু করেন জিয়াউল। পরে সেই পরিসর বাড়তে থাকে। জয়পুরহাট, নওগাঁ, বগুড়া, রংপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলায়ও তখন টুর্নামেন্ট খেলতেন তিনি।
পলিটেকনিকে পড়াশোনা শেষে ২০০৭ সালের শুরুতে ঢাকায় চলে আসেন জিয়াউল হক; ভর্তি হন বেসরকারি ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে। এর মধ্যে ঢাকায় বাছাইপর্বে উতরে তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম বিভাগে ক্রিকেট খেলতে থাকেন। সব ভালোই চলছিল। কিন্তু সমস্যার শুরু ২০১৬ সালে। একটি ক্রিকেট ম্যাচে মেরুদণ্ডে বড় ধরনের চোট পান। তাতে ক্রিকেট খেলা বন্ধ করে দিতে হয় জিয়াউলকে। সেই সঙ্গে শেষ হয়ে যায় জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নও। খেলা ছেড়ে তাই উদ্যোক্তা হওয়ার পথে হাঁটতে শুরু করেন।
যেভাবে শুরু
জিয়াউল হক জানান, ঢাকা লিগের অন্যতম শর্ত ছিল প্রতি দলে ন্যূনতম দুজন করে বিদেশি খেলোয়াড় থাকতে হবে। ফলে লিগে খেলার সময় ভারত ও পাকিস্তানের কয়েকজন েখলোয়ােরর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। সেই সূত্র ধরে ২০১২ সালে ভারতে একজন কোচের কাছে তিন মাসের প্রশিক্ষণের জন্য যান জিয়াউল। পরে সেখানে গিয়ে খোঁজ পান উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মিরাট শহরের। ক্রিকেটের নানা সামগ্রী তৈরির জন৵ মিরাট শহর িবখ৵াত। ক্রিকেটসামগ্রী তৈরির বিশ্বের বড় বড় সব কোম্পানির কারখানা রয়েছে সেখানে।
জিয়াউল হক বলেন, দেশের মধ্যে আমদানি করা আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট ব্যাট ও বলের দাম অনেক বেশি হয়। যেমন ক্রিকেটের চামড়ার বলের কথাই ধরা যাক। ক্রিকেট ম্যাচে সব সময় নতুন বল দিয়ে খেলা হয়। কারণ, নতুন বল ভালো সুইং করে। এ কারণে পেশাদার খেলোয়াড়েরা অনুশীলন করার সময় নতুন বলে ব্যাটিং করে অভ্যস্ত হন। কিন্তু লেদার বলের দাম অনেক বেশি। এ কারণে অনেকেই অনুশীলনের সময় নতুন বলে খেলার সুযোগ পান না।
কিন্তু ভারতের মিরাটে দেখলাম এসব পণ্য প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি হয়। ২০১২ সালের দিকে যে বল ঢাকায় ৫০০ টাকায় বিক্রি হতো, সেই বল মিরাটে পাওয়া যেত মাত্র ২০০ টাকায়। আবার সে সময় দেশে ভালো মানের ক্রিকেট ব্যাটের দাম ছিল ১২-১৫ হাজার টাকা। একই ব্যাট মিরাটে বিক্রি হতো মাত্র ৫ হাজার টাকায়।
জিয়াউল হক বলেন, দামের এ তারতম্য দেখেই মূলত আমার ক্রিকেট ব্যাট-বল তৈরির উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়। আমি ভাবলাম, দেশে যদি কাঁচামাল এনে এসব উপকরণ তৈরি করতে পারি, তাহলে অনেক সাশ্রয়ী দামে তা বিক্রি করা সম্ভব হবে।
শুরুর বিনিয়োগ
বিভিন্ন সময় ক্রিকেট খেলে যে আয় হতো, তা মায়ের কাছে জমা রাখতেন জিয়াউল। জমা ওই টাকা দিয়ে একটি বাড়ি কিনেছিলেন তাঁর মা। পরে সেই বাড়ি বিক্রি করে ব্যবসার কাজে বিনিয়োগ করেন জিয়াউল। এ ছাড়া বিনিয়োগের জন্য তাঁর মা-বাবা এবং ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়েছেন তিনি।
শুরুতে তনিন ট্রেডার্স নামে ভারত থেকে ব্যাট-বলসহ অন্যান্য ক্রিকেটসামগ্রী আমদানি করতেন তিনি। এ কাজ করতে গিয়ে মিরাটের অভিজ্ঞ কারিগরদের সঙ্গে সখ্য তৈরি করেন। পাশাপাশি ২০১৬ সাল থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে নিজের কারখানা স্থাপনের কাজও এগিয়ে নিতে থাকেন। এতে এখন পর্যন্ত ব্যাংকঋণসহ কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন এই উদ্যোক্তা।
ভারত থেকে আনা হয় কারিগর
দেশে ভালো মানের ব্যাট ও অন্যান্য ক্রিকেটসামগ্রী তৈরির জন্য ভারত থেকে ১২ জন দক্ষ কারিগর নিয়ে আসেন জিয়াউল। তাঁদের পাসপোর্ট তৈরি থেকে শুরু করে দেশে থাকার যাবতীয় ব্যয়ভার তাঁকেই বহন করতে হয়।
এ ছাড়া তাঁদের সুবিধার জন্য কারখানা প্রাঙ্গণে তৈরি করেছেন ক্রিকেট পিচ, সুইমিংপুল, ব্যায়ামাগার, টেনিস ও ব্যাডমিন্টন কোর্ট। এই কারিগরদের মাধ্যমে স্থানীয় ১৪ জন কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রশিক্ষণ পাওয়া দেশীয় কারিগরেরাই জিয়াউলের কারখানায় পণ্য তৈরি করছেন।
আমদানি ও পণ্য তৈরিতে লেগেছে সময়
ভারতের গাজিয়াবাদ থেকে ক্রিকেটসামগ্রী তৈরির যন্ত্র আমদানি করেন জিয়াউল হক। কিন্তু সমস্যা বাধে ব্যাট তৈরির কাঠ ও ল্যাভলন আমদানি করতে গিয়ে। এই দুই পণ্যের জন্য তখন কোনো এইচএস কোড ছিল না। এ কারণে নতুন করে কোড তৈরি করে সেসব পণ্য আনতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।
জিয়াউল বলেন, ‘শ্রমিকদের শেখানোর জন্য অনেক কাঁচামাল ও উপকরণ নষ্ট হয়েছে আমার। এ ছাড়া করোনার সময় প্রায় সাত মাস কাঁচামাল আমদানি একদমই বন্ধ ছিল। এ রকম নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে।’
বর্তমান অবস্থা
জিয়াউলের কারখানায় বর্তমানে পাঁচের অধিক ক্রিকেট পণ্যসামগ্রী তৈরি হয়। এর মধ্যে রয়েছে টেনিস, উইলো ও অটোগ্রাফ ব্যাট, লেদার বল, গ্লাভস, প্যাড, থাই ও চেস্টগার্ড ইত্যাদি। এর মধ্যে গ্লাভস-প্যাডের প্রধান কাঁচামাল ল্যাভলন আনেন ভারতের মিরাট ও পাঞ্জাব থেকে। আর ব্যাটের জন্য কাঠ আনেন মিরাট ও কাশ্মীর থেকে। জিয়াউল জানান, কাশ্মীরের কাঠ দিয়ে ভালো মানের ক্রিকেট ব্যাট তৈরি হয়।
নিজের ব্যবসাকে অনেকটাই গুছিয়ে এনেছেন তিনি। বর্তমানে সারা দেশে তনিন স্পোর্টসের পণ্যের পরিবেশক রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই রয়েছে ২০ জনের বেশি পরিবেশক। তবে চাহিদা সাপেক্ষে পণ্য বানান জিয়াউল। বর্তমানে ৭ হাজার পিসের মতো ক্রিকেট ব্যাট এবং সাড়ে তিন হাজারের বেশি অন্যান্য পণ্য তৈরি হয় তাঁর কারখানায়। জিয়াউল জানান, তিনি আমদানি করা পণ্যের তুলনায় ৪০ শতাংশ কম দামে একই মানের পণ্য গ্রাহকদের দিচ্ছেন।
এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পণ্য রপ্তানি শুরু করেননি জিয়াউল। তবে ভবিষ্যতে সেই ইচ্ছে আছে বলে জানান তিনি। জিয়াউল হক বলেন, ‘আমি টিএন স্পোর্টসকে একটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’