প্রকাশকালঃ
১১ জুলাই ২০২৩ ০২:৩৬ অপরাহ্ণ ১৭৭ বার পঠিত
সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরজুড়েই অর্থনীতিতে ছিল নানা সংকট। মূল্যস্ফীতির চাপ ছিল সাধারণের জন্য অসহনীয়।
কাঁচা মরিচের মতো একটি পণ্য ভোক্তার পকেট কতটা কাটতে পারে, সেটা দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একেবারে শুরুতেই। অন্তত ৭০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে এই পণ্য। আরও বেশি দামের কথাও শোনা গেছে। আমদানির খবরে মাঝখানে খানিকটা কমলেও কাঁচা মরিচের দাম আবার বাড়তি। তবে নতুন অর্থবছরে শুধু কাঁচা মরিচ একা সাধারণ ভোক্তাদের কপালে ভাঁজ ফেলছে এমন নয়; বাজারে দাম বাড়তি প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের।
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হঠাৎ করে নতুন অর্থবছরে ঘটেনি। সত্যিকার অর্থে সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে কম আর সীমিত আয়ের মানুষ নাকানিচুবানি খেয়েছেন প্রায় সব ধরনের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। বছরজুড়ে ছিল মূল্যস্ফীতির দাপট। গত এক দশকে মূল্যস্ফীতির এত চাপ মানুষকে সহ্য করতে হয়নি। মূল্যস্ফীতি আগের অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২১-২২ সালেও বাড়তি ছিল। কিন্তু সরকারের প্রত্যাশা ছিল বিদায়ী অর্থবছরে এই হার হবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানাচ্ছে, বছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ০২ শতাংশ—বছরওয়ারি হিসাবে যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির এই চোখরাঙানি অবশ্য কেবল বাংলাদেশ দেখেছে এমন নয়। কোভিড মহামারি থেকে উত্তরণ হতে না হতেই ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সারা বিশ্বেই পণ্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। মূল্যস্ফীতি থেকে বাঁচতে প্রায় সব দেশই লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় নীতি সুদহার বৃদ্ধিকে। এ সময় পৃথিবীর হাতে গোনা যে কয়টা দেশ সুদের হার বাড়ানোর পথে হাঁটেনি, বাংলাদেশ তার একটি। সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ টানা ১০ বার সুদের হার বাড়িয়ে ১৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়। ফলে ডলার মহার্ঘ্য বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ ডলারের দাম ধরে রাখার ভুল নীতি বেছে নেয়। সেই সঙ্গে কমতে থাকে প্রবাসী আয় এবং রপ্তানি। ফলে পুরো অর্থবছরে আর্থিক আর ব্যবসা-বাণিজ্যের অঙ্গনে যে শব্দগুচ্ছ সবচেয়ে বেশি শোনা গেছে, তা হলো ‘ডলার–সংকট’।
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের মতো ডলারের এতটা সংকট বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে আর দেখেনি। ফলে আমদানি সংকুচিত করতে হয়। ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, তাঁরা আমদানির জন্য ডলার পাননি। একদিকে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, অন্যদিকে সংকটের কারণে স্থানীয়ভাবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি—এই দুইয়ে মিলে দেশে পণ্যমূল্য বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমে যাওয়ার কারণে সরকারের লেনদেনে রেকর্ড ঘাটতি দেখা দেয়, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে, ঋণ পরিশোধের খরচ বাড়ে। ডলার-সংকটের কারণে বাড়ে জ্বালানিসংকটও। ফলে শিল্পকারখানা ভুগেছে সেদিক থেকেও।
তবে নীতি সুদহারের আগ্রাসী বৃদ্ধি, সঙ্গে বিশ্ববাজারে পণ্য সরবরাহ বেড়ে দাম কমে আসা—এসবের কারণে অনেক দেশই সাফল্যের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনে। যেসব দেশ এ সময়ে মূল্যস্ফীতি কমাতে পারেনি, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম।
বিদায়ী অর্থবছরে সংকট ছিল প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও। টাকার মান ধরে রাখতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে শত শত কোটি ডলার ছেড়েছে এ সময়। কিন্তু খালি পাত্র ভরার ব্যবস্থা হয়নি। ব্যাংকে ডলারের দর কমিয়ে রাখা গেলেও খোলাবাজারে ডলারের দাম এতটা বাড়ে যে অনেক প্রবাসীই আনুষ্ঠানিক পথে অর্থ পাঠাতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশে ডলারের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দামের ব্যবধান ছিল ১২ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত। বিনিময় হারে ১ শতাংশ ব্যবধানের কারণে আনুষ্ঠানিক খাত থেকে প্রায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবাসী আয় অনানুষ্ঠানিক খাতে চলে যায়। ফলে কী পরিমাণ প্রবাসী আয় ব্যাংক খাতের বাইরে চলে যায়, তা এই হিসাব থেকে ধারণা করা যায়। অর্থবছর শেষে অবশ্য প্রবাসী আয়ে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটে। যদিও আগের অর্থবছরে ১৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
রপ্তানি আয়েও শেষ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ছিল অল্প। যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। তৈরি পোশাকের কল্যাণে রপ্তানি আয় ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় বাড়লেও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পরের বড় পাঁচ খাতের রপ্তানির চিত্র। বিদায়ী অর্থবছরে সব কটিতে প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক। এ ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তার বড় কারণ প্রধান কয়েকটি রপ্তানি বাজারে রপ্তানি কমে যাওয়া।
খুঁড়িয়ে চলা রপ্তানি ও ঝিমিয়ে পড়া প্রবাসী আয় স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব ফেলেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। অর্থবছর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের মতো—গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে যা সবচেয়ে কম। শুধু তা–ই নয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ অনুসরণ করে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের হিসাব করলে প্রকৃত রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারের মতো দাঁড়াবে। রিজার্ভ শিগগিরই বাড়বে, এমন সম্ভাবনা খুব নেই বলেই মনে হয়। রিজার্ভ বাড়াতে হলে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়াতে আগ্রাসী পদক্ষেপ নিতে হবে।
ব্যবসায়ীরা যতই অসন্তোষ প্রকাশ করুন না কেন, সরকারের চেষ্টা ফল দিয়েছে আমদানি নিয়ন্ত্রণে। আমদানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ এবং ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি বিদায়ী অর্থবছরে আমদানি কমিয়েছে ১৫ শতাংশ। যদিও আগের অর্থবছরে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
অনেকটা ধারাবাহিকভাবেই রাজস্ব আদায়ে গত অর্থবছরে ঘাটতি হয়েছে। সাময়িক হিসাবে, রাজস্ব আদায় হয়েছে সোয়া ৩ লাখ কোটি টাকার কিছুটা বেশি। ঘাটতির পরিমাণ শেষ পর্যন্ত ৪৫ হাজার কোটি টাকা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাতে এ সময় কমেছে। নতুন অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে জিডিপির ২৮ শতাংশের কাছাকাছি নেওয়ার যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তা কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যে কমবে, এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত ছিল না। শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে।
অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থার মধ্যে আইএমএফের পরামর্শে নতুন অর্থবছরে ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সুদের হার বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর নীতি থেকে কিছুটা হলেও সরে দাঁড়িয়েছে সরকার। রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টার কথা বলা হয়েছে, তবে কতটা সাফল্য আসবে, তা নিয়ে সন্দেহ কাটছে না। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, আর এটাকেই অনেকে দেখছেন বাস্তবতা স্বীকার না করার একটি প্রবণতা হিসেবে। কাঁচা মরিচের মতো একটি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতেই কর্তৃপক্ষের গলদঘর্ম অবস্থা। তাই নিত্যপণের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টিকে অনেকেই হয়তো বছর শেষে সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্যের একটি মাপকাঠি হিসেবে দেখতে চাইবেন।