অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণ ও স্থানীয় প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে জুলাইয়ের শেষদিকে বাসমতি ছাড়া অন্য চালের রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারত। বিশ্বের বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক থেকে আসা এ নিষেধাজ্ঞা বিশ্ববাজারে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। কারণ বিশ্বের কয়েক ডজন দেশ, বিশেষ করে এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলো ভারতীয় চালের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া এ নিষেধাজ্ঞা তাদের অভ্যন্তরীণ চাল রপ্তানির এক-চতুর্থাংশকেও প্রভাবিত করছে।
বলা হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে শস্যচুক্তি থেকে রাশিয়ার বের হয়ে যাওয়ার পরপরই চাল রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা একটি বিস্তৃত খাদ্যসংকট উসকে দেওয়ার ইঙ্গিত দেয়। এরই মধ্যে তাদের এ সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বেড়েছে এবং ক্ষুধার আশঙ্কা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারত বলছে, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, চরম জলবায়ু, খারাপ আবহাওয়ার (এল নিনো) প্রভাবসহ নানা কারণে তারা চাল রপ্তানি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
এর আগে ২০২২ সালে তীব্র তাপপবাহের ফলে ভারতের গম উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে যায়। সে সময় নয়াদিল্লি গম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও সে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়নি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গম উৎপাদনকারী এ দেশ। অন্যদিকে শস্যচুক্তি বাতিল হওয়ার পর ইউক্রেন থেকেও গম রপ্তানি এক প্রকার বন্ধ। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দামও ঊর্ধ্বমুখী।
অন্যদিকে বিশ্বের বৃহত্তম সয়াবিন রপ্তানিকারক ও শীর্ষ ভুট্টা উৎপাদনকারী দেশ আর্জেন্টিনা ৬০ বছরের মধ্যে চরম খরায় ভুগছে, ফলে এ দুটি শস্যের ফলনও তীব্রভাবে কমে গেছে। সয়াবিন উৎপাদনে শীর্ষ আরেকটি দেশ ব্রাজিলও সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও খরার শিকার হয়েছে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে কানাডায় ১৪ বছরের মধ্যে ক্যানোলা তেলের সর্বনিম্ন ফলন হয়েছে।
বিশ্বের বৃহত্তম পাম তেল রপ্তানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির মধ্যেই গত বছর সাময়িকভাবে পাম তেল রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সূর্যমুখী তেলের সরবরাহও কমে গেছে। সব মিলিয়ে ভোজ্য তেলের বাজারেও অস্থিরতা বিদ্যমান। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠতেই পারে, চিরস্থায়ী খাদ্যসংকট কি পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হতে চলেছে? এমতাবস্থায় বিশ্ব এখন কি করতে পারে? এক্ষেত্রে উত্তর হলো, চরম আবহাওয়া, রপ্তানিরোধ ও ভূরাজনৈতিক ফাটল বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তাকে চিরস্থায়ী ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর একটা সমাধান আছে। অবাধ বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনকে আরো ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারে এমন ফসলের উন্নত জাত আবিষ্কার মানুষকে আসন্ন সংকট মোকাবিলা করতে সাহায্য করতে পারে।
ক্রমবর্ধমান রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা
চাল বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যার প্রধান খাদ্য ও প্রতি বছর বিশ্ব জুড়ে ৫০০ মিলিয়ন মেট্রিক টনেরও বেশি চাল খাওয়া হয়। বিশ্বব্যাপী চাল রপ্তানির ৪০ শতাংশে ভারতের অবদান রয়েছে। অন্য বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশগুলো হলো থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) চালের বাজার বিশ্লেষক শার্লি মুস্তাফা বলেন, ভারত বাসমতি ছাড়া অন্য সব চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি আতপ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ কর আরোপ করেছে। অথচ গত দুই বছরে এ ধরনের চালের বিশ্ববাজারে প্রায় ১০ শতাংশ চাহিদা বেড়েছে। সম্প্রতি ক্যামেরুন, মাদাগাস্কার ও কটে ডি’আইভরির মতো আফ্রিকান দেশগুলো এ ধরনের চালের অন্যতম প্রধান ক্রেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
তিনি বলেন, এ ধরনের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। বিশেষ করে, সংকটের ভয়ে বেশি চাল কিনতে চাওয়া দরিদ্র দেশগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে রাশিয়া এবং উগান্ডা সূর্যমুখী তেল, গম, বার্লি, ভুট্টা ও চালের মতো কিছু পণ্যের ওপর রপ্তানি কর আরোপ করেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘সামরিক অভিযান’ শুরু হওয়ার পর থেকে বাণিজ্য-সীমাবদ্ধ করার নীতিগুলোর প্রয়োগ বিশেষভাবে বেড়েছে।
ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা
এফএওর ২০২৩ সালের স্টেট অব ফুড ইনসিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট অনুসারে, ২০২২ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ দশমিক ২ শতাংশ বা ৬৯ কোটি ১০ লাখ থেকে ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছে, যা ২০১৯ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। কানাডা ও ইউরোপে দাবানল, দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব আফ্রিকায় খরা, চীনে বন্যা ও ক্যালিফোর্নিয়ার শুষ্ক অংশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্যসংকট আরো বেড়েছে।
প্রতিকূল জলবায়ু
২০২২ সালে পাকিস্তানের বিশাল অংশ জুড়ে বিধ্বংসী বন্যার কারণে প্রায় চেক প্রজাতন্ত্রের আয়তনের সমান কৃষিজমি প্লাবিত হয়। ঐ বন্যায় দেশটির ৮০ শতাংশেরও বেশি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও চরম খাদ্যসংকটে তৈরি করে। বর্তমানে প্রতিনিয়ত চরম আবহাওয়ার মুখোমুখি হচ্ছে আর্জেন্টিনা ও স্পেন, যারা চলতি বছর অভূতপূর্ব খরার সম্মুখীন হয়েছে। এমন সময় অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে, এ বছর তাদের গমের ফলনে নাটকীয়ভাবে হ্রাস ঘটতে চলেছে।
এ বছর বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম শস্য রপ্তানিকারক দেশটির গমের উৎপাদন ৩৪ শতাংশ হ্রাস পেতে চলেছে। নিউ ইয়র্কভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্পর্কিত কৃষি-শিল্প বিশ্লেষণ সংস্থা গ্রো ইন্টেলিজেন্সের মতে, উচ্চ তাপমাত্রা যুক্তরাষ্ট্রের ভুট্টার ফলনের পাশাপাশি ইউরোপ ও কানাডায় গমের উত্পাদনকেও প্রভাবিত করছে। কেনিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, হাইতি, চিলি ও বলিভিয়ায়ও এ বছর প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফসলের ফলন কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।