ভোলায় বেড়াতে যাওয়ার আগে জেনে নিন ঘোরাঘুরি আর থাকা-খাওয়ার খুঁটিনাটি

প্রকাশকালঃ ১৪ মার্চ ২০২৩ ১২:১৬ অপরাহ্ণ ২৪৩ বার পঠিত
ভোলায় বেড়াতে যাওয়ার আগে জেনে নিন ঘোরাঘুরি আর থাকা-খাওয়ার খুঁটিনাটি

রুপালি ইলিশ, পাখির ঝাঁক, সবুজ বনে দুরন্ত হরিণ, নদীর চরে মহিষের বাথান কতই না শোভা সাগরমোহনার বদ্বীপ জেলা ভোলার ।  আপনিও ঘুরে আসতে পারেন প্রকৃতির এই শান্ত-স্নিগ্ধ সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভোলা। ঢাকার সদরঘাট থেকে যাত্রা শুরু করতে পারেন। সদরঘাট থেকে সকাল ৭টা থেকে লঞ্চ ছাড়া শুরু হয় এবং চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। বিশাল লঞ্চে উপভোগ্য হয়ে ওঠে নৌভ্রমণ। সড়কপথে বরিশাল নেমে স্পিডবোটেও ভোলায় যাওয়া যায়। ভোলা নৌপথে নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর হয়েও  পৌঁছানো যায় । 

ভোলা সদর
ঢাকা থেকে সন্ধ্যায় রওনা দিলে ভোলা (খেয়াঘাট) ভোরে  নদীবন্দর ও ইলিশা ঘাটে লঞ্চ পৌঁছাবে। ভোলা নদীবন্দরে নামলে খেয়াঘাট সেতু, আরেকটু সামনে ব্যাংকের হাট, ভেলুমিয়া, শাজাহানবাজার, তারপর তেঁতুলিয়া নদী ঘুরে আসতে পারেন। সেখানে ডিঙিতে জেলেদের মাছ শিকার, শত শত পাখির ওড়াউড়ি, কৃষকের চাষাবাদ পরিচয় করিয়ে দেবে দ্বীপ জেলার জীবন ও জীবিকার সঙ্গে। নদীবন্দরের পাশে ভোলাখাল পেরিয়ে বেবিল্যান্ড শিশুপার্ক। এখানকার নির্মল পরিবেশে কাটিয়ে দিতে পারবেন অনেকটা সময়। শিশুপার্ক থেকে বেরিয়ে রিকশায় ছোট্ট শহর ভোলা দেখতে দেখতে চলে যেতে পারেন হোটেলে। থাকার জন্য ক্রিস্টাল-ইন, প্যাপিলন, কর্ণফুলীর মতো বেশ কিছু ভালো মানের হোটেল গড়ে উঠেছে। অনলাইনে আগেভাগেই বুকিং দেওয়া যায় লঞ্চ কেবিন,সিঙ্গেল কেবিন ২ হাজার ও ডাবল কেবিন ৩ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে।যদি ইলিশা লঞ্চঘাটে নামেন, তাহলে ঘাটের পাশে মেঘনার তীরে আছে গাজীপুর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। যেখান থেকে সাগরের মতো উত্তাল মেঘনা নদীর অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। ডাবল কেবিনের ভাড়া দেড় হাজার এবং সিঙ্গেল এক হাজার টাকা। খাবারের জন্য আলাদা বিল দিতে হবে। এখানে ভোলার ঐতিহ্য মহিষের কাঁচা দধি, শতভাগ খাঁটি ঘি ও উন্নত মানের মিষ্টি পাওয়া যায়, যা আপনি নিয়ে যেতেও পারবেন। হোটেলে ব্যাগ রেখে মেঘনার তীরে চলে যেতে পারেন তুলাতুলির ইলিশ বাড়ি, শাহবাজপুর পর্যটন এলাকায়। মেঘনার তীর ধরে ব্লক ফেলা ধুলামাখা পথে হাঁটতে পারেন এবং সবজিখেত আর ঝাউবনের ছায়ায় কাটাতে পারেন কিছু সময়। "ইলিশ বাড়ি" রেস্টুরেন্টে ইলিশের বারবিকিউসহ পেয়ে যাবেন মানসম্পন্ন খাবার। তুলাতুলি থেকে ইচ্ছা করলে মেঘনায় জেগে ওঠা মদনপুর চরে নৌকায় চড়ে  ঘুরে আসতে পারেন শব্দহীন, ছিমছাম পরিবেশে। মোটরসাইকেলে করে কলাগাছে ঘেরা ইউনিয়নটি কয়েক মিনিটে ঘুরে দেখতে পারেন। মেঘনা পার হতে হতে দেখবেন জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, একটু দাঁড়িয়ে ইলিশের ছোটাছুটিও দেখতে পারেন। এই মদনপুরের চরে আছে মহিষের বাথান। এখানকার ঘন দুধের চা, সঙ্গে মোতা ধানের মুড়ি আর গাছপাকা বাংলা কলায় মিটবে নাশতার চাহিদা। বিকেলটা তেঁতুলিয়া নদী তীরের বঙ্গবন্ধু পার্কে  অনায়াসে কাটিয়ে আসতে পারেন । তেঁতুলিয়া নদীর নীল জল পর্যন্ত নেমে গেছে ধাপে ধাপে সিঁড়ি। ঘাটে গেলে চোখে পড়ে চারদিকের অপরূপ নয়নাভিরাম দৃশ্য। ভোলার সদর উপজেলার দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামে বঙ্গবন্ধু পার্ক। সেখানে যাওয়ার সময় পথে দেখতে পারেন বাংলাবাজার উপশহরে স্বাধীনতা জাদুঘর আরও এগিয়ে গেলে দেখতে পারবেন ৭০০ বছরের পুরোনো মসজিদ। বঙ্গবন্ধু পার্কে ভোলা শহর থেকে যেতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, মাইক্রোবাস নিতে পারেন। রিকশায় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা নেবে তবে দর করে উঠতে হবে আর যদি ভেঙে ভেঙে গেলে খরচ কম পড়বে। সে ক্ষেত্রে ভোলা শহর থেকে মোস্তফা কামাল বাসস্ট্যান্ড গিয়ে বাসে বাংলাবাজার, বাংলাবাজার থেকে কোড়ালিয়া গাড়িঘাটা। যেতে-আসতে জনপ্রতি সর্বোচ্চ এক–দেড় শ টাকা খরচ হবে। ভোলা শহর ও অন্যান্য উপজেলার হোটেল-রেস্টুরেন্টে মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর টাটকা ইলিশ, পোয়া, কোরাল, চিংড়ি, পাঙাশসহ নানা রকম মাছের স্বাদ নিতে পারেন।

মনপুরা
ঢাকা থেকে ভোলার সাতটি উপজেলাতেই লঞ্চে যাতায়াত করা যায়। মনপুরা উপজেলায় যেতে লঞ্চের সিঙ্গেল কেবিনের ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ডাবল কেবিন ২ হাজার ৪০০ টাকা। ৬০০-৭০০ টাকায় ডেকেও আসা যায়। ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে ভিআইপি ও ফ্যামিলি কেবিন আছে। লঞ্চ খুব ভোরে নোঙর করে উপজেলার রামনেওয়াজ লঞ্চঘাটে। আপনাকে যেতে হবে আধো অন্ধকারে অটোরিকশায় উপজেলা শহর হাজিরহাট। অটোরিকশায় ভাড়া নিবে ২০০-৩০০ টাকা। ইচ্ছা করলে ঘাটের কাছের কোনো হোটেলেও উঠতে পারেন। মনপুরার আশপাশসহ এক দিনে ঢালচর ও কলাতলী ঘুরে দেখতে পারেন। হাজিরহাটে আছে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে এখানে ফ্যামিলি কেবিন ১ হাজার টাকা। এ ছাড়া হাজিরহাটে অহি, হানিফসহ একাধিক আবাসিক হোটেল আছ যার ভাড়া ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। হাজিরহাট থেকে আরও দক্ষিণে সিরাজগঞ্জ বাজার, সেখানে আছে হোটেল সমুদ্র বিলাস যার ভাড়া ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। দরদাম করে উঠলে আরও কমে থাকা যায়। মনপুরার দক্ষিণে দখিনা হাওয়া সি বিচ। আর পুরো মনপুরায় বন আর বন, পাখি আর নীলাকাশ। এখানে মেঘনার পূর্ব-পশ্চিমে উদয়াস্ত দেখা যায়।

চরফ্যাশন
ভোলা থেকে চরফ্যাশন সড়কের দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার। ভোলায় নেমে সড়কপথে চরফ্যাশন যাওয়া যায়। সরাসরি লঞ্চে চরফ্যাশন যেতে ঢাকা থেকে বেতুয়া ও ঢাকা থেকে ঘোষেরহাট নৌপথের লঞ্চে উঠতে হবে। ভোরে লঞ্চ থেকে নেমে সকালের নাশতা সেরে বেতুয়ার আশপাশে ঘন ম্যানগ্রোভ বনায়ন ঘুরতে পারবেন। উত্তাল, বিস্তৃত মেঘনার দিকে তাকালে মন ভরে যাবে। চরফ্যাশন শহরে আছে জ্যাকব টাওয়ার, শেখ রাসেল শিশুপার্ক। সরকারি-বেসরকারি রেস্টহাউস ছাড়াও আছে বেশ কিছু ভালো হোটেল যার ভাড়া ২৫০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। খামারবাড়ি রিসোর্ট সেন্টারেও থাকতে পারেন। এখানে প্রতি রাতে কেবিনের ভাড়া ৮-১৬ হাজার টাকা।চরফ্যাশন উপজেলার মূল ভূখণ্ডের শেষ থেকে মেঘনা নদীর মাঝ দিয়ে সাগরমোহনার ভাসানচর পর্যন্ত থেকে থেকে চর। সাগর মোহনায় আছে চর কুকরিমুকরি ও ঢালচর। এসব চরে শীতে আসে পরিযায়ী পাখি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে হাওরাঞ্চলের পরে বেশি পাখি আসে ভোলার চরাঞ্চলে। এসব পাখি দেখতে প্রতিবছরের জানুয়ারিতে দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষক ও পর্যটকেরা আসেন। আসে পাখিশুমারি দল। নদীর চরে নানা প্রজাতির পরিযায়ী জলচর পাখি খাবার খুঁটে খায়। আবার সারা বছরই আছে দেশীয় জলচর পাখি। চর কুকরিমুকরিতে আছে বার্ড ওয়াচ টাওয়ার। চরফ্যাশন থেকে বাস, মাইক্রো কিংবা মোটরসাইকেলে আপনাকে যেতে হবে কচ্ছপিয়া ঘাট। সেখান থেকে ট্রলার, স্পিডবোট কিংবা লাইনের লঞ্চে আপনি চর কুকরিমুকরির শ্বাসমূলীয় বনে যেতে পারেন। এই বনে হরিণ ছাড়াও নানা রকম বন্য প্রাণী এবং নদীতে ভোঁদড় দেখতে পাবেন। তবে সবচেয়ে ভালো হয়, ডিঙি ভাড়া নিয়ে জোয়ারের সময় বনের ভেতরের খাল পরিদর্শন করা। সেই যাত্রায় সুন্দরবন ভ্রমণের আবহটা পেয়ে যাবেন। চর কুকরিমুকরিতে আছে বন বিভাগের রেস্টহাউস। যার ভাড়া পড়বে ফ্যামিলি কেবিন ২ হাজার আর ভিআইপি কেবিন ৫ হাজার টাকা আর আছে হোম স্টে সেবা, যেখানে সিঙ্গেল বেড ৩০০ টাকা। চর কুকরিমুকরি থেকেই আপনি আরও দক্ষিণের ঢালচর যেতে পারেন। ঢালচরেই আছে তাড়ুয়া সি-বিচ। নদীপথে, সবুজ বনের খালের দুই পাশে আপনার সঙ্গী হবে নানা রকম হাঁস, বক, পানকৌড়ি, হটটিটি আর মাছরাঙা। শীতে সাগর মোহনা আর মেঘনা-তেঁতুলিয়ার পানি শান্ত, স্বচ্ছ। হাত ডোবালে হাতের রেখা দেখা যায়। এই নীল জলের বুকে পড়ে ঝিলিক মারে রাতের চাঁদ, দিনের সূর্য। কিছু দূর যেতে না যেতে সবুজ দ্বীপ। দক্ষিণে ভোলাকে ঘিরে আছে এসব সবুজের দ্বীপ।