বৃহত্তর জমায়েত আলেমদের জানাজায়

প্রকাশকালঃ ০৭ জুন ২০২৩ ০৩:৪৮ অপরাহ্ণ ১১৫ বার পঠিত
বৃহত্তর জমায়েত আলেমদের জানাজায়

সলামে জানাজার নামাজের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মুমিনদের তাতে অংশ নিতে বিশেষভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। মুসলিমদের পরকালীন জীবনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় এ নামাজের মাধ্যমে। জানাজায় অংশ নেওয়া ফরজে কিফায়া; অর্থাৎ কিছু লোক পালন করলে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়।

যারা জীবনভর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ইসলাম ও মুসলিমদের সেবায় নিয়োজিত থাকেন তাদের জানাজায় উপস্থিত হওয়া কর্তব্য। কারণ জানাজায় মুসল্লিদের উপস্থিতি মৃত ব্যক্তির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, কোনো মৃত ব্যক্তির জানাজায় এক শ জন মুসলিমের দল উপস্থিত হলে এবং তারা সবাই তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার সুপারিশ করলে তাদের এই সুপারিশ কবুল হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯৪৭)

জানাজার নামাজে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা সব সময় মৃত ব্যক্তির ভালো বা মন্দ আমল নির্ধারণে বিবেচ্য না হলেও তা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।


তাই হাদিসের বর্ণনা অনুসারে চল্লিশজন বা এক শ জন উপস্থিত হলেই তা পরকালে ক্ষমা লাভের জন্য যথেষ্ট। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.)-এর এক ছেলে কুদাইদ বা উসফান নামক স্থানে মারা যায়। তখন তিনি কুরাইব (রা.)-কে বলেন, হে কুরাইব, দেখো, কেমন মানুষ উপস্থিত হয়েছে। তিনি বের হয়ে দেখেন, কিছু লোক জানাজার জন্য উপস্থিত হয়েছে।

বিষয়টি তাকে জানানো হলে তিনি বললেন, তারা কি চল্লিশজন হবে? তাকে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেওয়া হলে তিনি মরদেহ বের করতে বলেন। অতঃপর বললেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যদি কোনো মৃত মুসলিমের জানাজায় চল্লিশজন অংশ নেয় এবং তারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক না করে আল্লাহ তাদের সুপারিশ কবুল করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯৪৮) 

তা ছাড়া অংশগ্রহণকারী অল্প কাজের বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ সওয়াবের অধিকারী হন। সাধারণত খুব কম সংখ্যক মানুষের এ ধরনের সুযোগ মেলে। তাই জানাজা ও দাফন কার্যে অংশ নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।


আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, কেউ জানাজার নামাজে উপস্থিত হয়ে নামাজ পড়লে তার জন্য এক কিরাত পরিমাণ সওয়াব। আর কেউ দাফন হওয়া পর্যন্ত উপস্থিত থাকলে তার জন্য দুই কিরাত পরিমাণ সওয়াব থাকবে। জিজ্ঞাসা করা হলো, দুই কিরাত কী? তিনি বলেছেন, দুটি বিশাল পাহাড় পরিমাণ।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩২৫) 

সাম্প্রতিককালে দেশের অনেক শীর্ষ আলেম মারা গেছেন। তাদের জানাজার নামাজে বিপুল সংখ্যক মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। অকৃত্রিম ভক্তির অনেকের জন্য অকল্পনীয় মনে হলেও যুগ ‍যুগ ধরে সাধারণ মুসলিমদের অন্তরে স্থান করে নেওয়া আলেমদের জানাজায় দৃশ্য এমনি। মূলত যারা নিষ্ঠার সঙ্গে ইসলাম ও মুসলিম জাতির কল্যাণে নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি, জীবন ও সম্পদ ব্যয় করেন তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। বিদায়ের মুহূর্তে জানাজার নামাজে অংশ নিয়ে তাদের প্রেম ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অনেক বিখ্যাত মুসলিম মনীষীর জানাজাতে বিপুল মানুষের অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানা যায়। 

এক্ষেত্রে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.)-এর একটি উক্তি তৎকালীন বাগদাদে বহুল প্রচলিত ছিল। দারু কুতনি (রহ.) আবদুল্লাহ বিন আহমদ (রহ.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আমি আমার বাবাকে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা বিদাতপন্থীদের বলে দাও, তোমাদের ও আমাদের মধ্যে জানাজার দিন সঠিকতার ফায়সালা হবে।’ (সুআলাতুস সিলমি লিদদারি কুতনি, পৃষ্ঠা : ৩৬১)


ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বিভিন্ন বিষয়ে মুতাজিলা সম্প্রদায়ের বিরোধিতার কারণে নির্যাতনের মুখোমুখী হয়েছেন। খলিফা আল-মামুন, খলিফা মুতাসিম, আল-ওয়াসিকের শাসনামলে কঠিন শাস্তি ভোগ করেন। ২৪১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল  ইরাকের ৭৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তখন তার জানাজার নামাজে লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। আল-মুনতাজাম গ্রন্থে বলা হয়, গভর্নর মুহাম্মদ বিন তাহির উপস্থিত লোকের সংখ্যা গণনার নির্দেশ দিলে জানা যায়, জানাজায় ১৭ লাখ মানুষ উপস্থিত হয়েছে। হাফিজ আবু জারাআ-এর বর্ণনা মতে, মুতাওয়াক্কিল বিল্লাহ উপস্থিত লোকদের দাঁড়ানোর স্থান মোছার নির্দেশ দেন। তখন এই সংখ্যা ২৫ লাখে পৌঁছে।

তাহজিবুল কামাল গ্রন্থে বলা হয়, তাঁর জানাজায় ৮ লাখ পুরুষ ও ৬০ হাজার নারী উপস্থিত হন। আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে বলা হয়, হাফেজ আবদুল ওয়াহাব আল-ওয়ারাক বলেছেন, জাহেলি ও ইসলামী যুগে আহমদ বিন হাম্বলের জানাজার চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ কোনো জানাজায় অংশ নিয়েছেন বলে আমরা জানি না। তার মৃত্যুর দিন ২০ হাজার অথবা ১০ হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে মুসলিমদের পাশাপাশি ইহুদি, খ্রিস্টান ও অগ্নিপূজকদের মধ্যেও শোক ছড়িয়ে পড়ে। এ থেকে বোঝা যায়, আহমদ বিন হাম্বল (রহ.)-এর জানাজায় বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ছিল। আর এর মাধ্যমে তাঁর উল্লিখিত উক্তির যথার্থতাও প্রমাণিত হয়। 

ইসলামের ইতিহাসে ইমাম বিন হাম্বলের পর শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর জানাজা বিশেষভাবে স্মরণীয়। তকি উদ্দিন আহমদ বিন তাইমিয়া (রহ.) ৭২৮ হিজরিতে দামেশকের কেল্লায় বন্দী অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর খবর শুনে জানাজায় অংশ নিতে দামেশকে মানুষের শ্রোত তৈরি হয়। এমন দৃশ্য দামেশ শহর আগে কখনো দেখেনি। জোহরের আগে জানাজা হলেও অত্যধিক ভিড়ের কারণে দাফন কার্য সম্পন্ন করতে করতে আসরের নামাজ শেষ হয়। আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থের বর্ণনা মতে, আনুমানিক তাতে ৬০ হাজার থেকে দুই লাখের বেশি লোক অংশ নেয়। মুসল্লিদের মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি নারীও ছিলেন। মূলত তার জানাজায় বিরোধী ও অক্ষম ব্যক্তি ছাড়া সবাই অংশগ্রহণ করে।