থামছে না তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন, নদীগর্ভে বিলীন অসংখ্য বসতবাড়ি

  প্রিন্ট করুন   প্রকাশকালঃ ২৮ মে ২০২৫ ১২:৫৩ অপরাহ্ণ   |   ১১৬ বার পঠিত
থামছে না তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন, নদীগর্ভে বিলীন অসংখ্য বসতবাড়ি

আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-


 

ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর তীরবর্তী কুড়িগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ভাঙন নতুন করে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নদ-নদীর পানি বাড়ার সাথে সাথে কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর, রৌমারী ও রাজারহাট উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। গত দুই সপ্তাহে শুধু ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি। আতঙ্কে রয়েছে সহস্রাধিক পরিবার, হুমকির মুখে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় স্থাপনা এবং বিস্তীর্ণ ফসলি জমি।
 

কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের রসুলপুর, মোল্লারহাট এবং রৌমারীর সোনাপুর, পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভাঙনরোধে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ। অনেকে ভিটেমাটি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ আগেভাগে ঘরবাড়ি, গাছপালা সরিয়ে নিচ্ছেন; কেউবা আবার ভাঙনের শিকার হওয়ার আগে থেকেই জমি ফাঁকা করে অপেক্ষা করছেন অনিবার্য নিয়তির জন্য।
 

উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের রসুলপুর এলাকার কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, এবার পানি বাড়ার পর থেকে প্রায় ৫০টি পরিবার একেবারে বসতভিটা হারিয়েছে। দিনে দিনে মাটি ধসে যাচ্ছে নদীতে। প্রশাসনের লোকজন আশ্বাস দেয়, কিন্তু কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না। যদি এখনই কিছু না করা হয়, আরও শত শত পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাবে।
 

রাবেয়া খাতুন নামে এক নারী বলেন, ‘আমার চোখের সামনে দুই ঘণ্টার মধ্যে বাড়ির বারান্দা, উঠান, রান্নাঘর সব নদীতে চলে গেল। স্বামী কয়েক বছর আগে মারা গেছেন, দুই ছেলে ঢাকা থাকে। এখন ছোট একটা ঝুপড়ি ঘরে অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছি। সরকার যদি ঘর করে না দেয়, তাহলে এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় থাকব?’
 

আব্দুল জলিল নামে এক বৃদ্ধ বলেন, ‘এখানে প্রতি বছর ভাঙে। আমরা জানি না কখন আমাদের ঘরটা যাবে। গত বছর স্কুলের পাশে বিশাল বাঁধ দেয়ার কথা ছিল, আজ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। শুধু কাগজে প্রকল্প আর লোক দেখানো পরিদর্শন। এমন চলতে থাকলে আগামী বর্ষায় স্কুলটাও থাকবে না।’
 

ব্রহ্মপুত্রের করাল গ্রাসে ইতোমধ্যেই ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে রসুলপুর, মোল্লারহাট, সোনাপুর, বিদ্যানন্দ ও ঘড়িয়ালডাঙ্গা গ্রামের শতাধিক পরিবার। স্থানীয়রা জানায়, তারা বহুবার প্রশাসনের বিভিন্ন দফরে যোগাযোগ করলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
 

উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ বাবলু মিয়া বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের তিন দিকেই নদী। আগের তুলনায় এবার ভাঙন অনেক বেশি। আমার ইউনিয়নের অর্ধেকটা নদীতে চলে গেছে। এবার কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই পুরো ইউনিয়নই মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।’
 

তিনি আরও জানান, ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ, সিসি ব্লক ফেলা বা বাঁধ নির্মাণ করা না হলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
 

এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, যেসব এলাকায় ভাঙন চলছে, সেসব এলাকা চিহ্নিত করে প্রতিরোধমূলক প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। আমরা বরাদ্দ পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। বরাদ্দ পেলে জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করা হবে।
 

সামাজিক সংগঠক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, কুড়িগ্রামের নদীভাঙন একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এখানে ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তা নদীর ধারা পরিবর্তনশীল। পানির গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে না আনা গেলে প্রতি বছর ভাঙন বাড়বে। স্থানীয়ভাবে গাইড বাঁধ, নদী শাসন ও ভাঙনপ্রবণ এলাকায় স্থায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। শুধু বর্ষাকালে জরুরি বরাদ্দ দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়।
 

রসুলপুর, বিদ্যানন্দ, ঘড়িয়ালডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙনের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে ভুক্তভোগীরা। তারা ‘ভিটা চাই, নদী নয়’, ‘প্রতিবছর ভাঙন, কবে মিলবে সমাধান?’ এমন নানা স্লোগানে সরকারের কাছে জরুরি হস্তক্ষেপের দাবি জানান।
 

উল্লেখ্য, কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর ও রৌমারী উপজেলার সাতটি পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র এবং রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ও বিদ্যানন্দের চারটি পয়েন্টে তিস্তা নদীতে ভাঙন চলছে। ভাঙন মোকাবিলায় নেই পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ, নেই শ্রমিক কিংবা কার্যকরী প্রহরী।
 

স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি মে মাসেই ভাঙনের কবলে পড়েছে প্রায় ১২০টি বসতবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ২৫০ বিঘা ফসলি জমি। এর মধ্যে অনেকেই এখন পর্যন্ত সরকারি ত্রাণ বা পুনর্বাসন সহায়তা পাননি।