ঢাকাই মসলিনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য

প্রকাশকালঃ ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:৫৩ অপরাহ্ণ ৫৫৮ বার পঠিত
ঢাকাই মসলিনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য

প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্যে যে নামটি তার আভিজাত্য আর নিজস্ব মহিমা নিয়ে জ্বলজ্বল করছে, তা হলো মসলিন, ঢাকাই মসলিন। একসময়ে শুধু বাংলা বা মুঘল রাজদরবারই নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীজুড়েই অতি সূক্ষ্ম, মিহি, মোলায়েম আর উজ্জ্বল এই বস্ত্র ছিলো চাহিদার শীর্ষে। ঢাকাই মসলিন হলো এক ধরনের অতি সূক্ষ্ম ও হালকা কাপড়, যা বাংলায় উৎপাদিত হয়। এটি বাংলার ঐতিহ্যবাহী পোশাক হিসেবে বিবেচিত হয়। ঢাকাই মসলিন তার সূক্ষ্মতা ও মানের জন্য বিখ্যাত ছিল।

এস. সি. বার্নেল ও হেনরি ইউল নামের দুজন ইংরেজ কতৃক প্রকাশিত অভিধান 'হবসন জবসন'-এ উল্লেখ করা হয়েছে মসলিন শব্দটি এসেছে 'মসুল' থেকে। মসলিন শাড়ির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ধারণা করা হয়, এটি প্রাচীন মিশরে আবিষ্কৃত হয়েছিল। তবে, মসলিন শাড়ি তার পূর্ণ বিকাশ লাভ করে বাংলায়। ঢাকাই মসলিনের ইতিহাস প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো। ধারণা করা হয়, ১৩ শতকে বাংলায় মসলিন শিল্পের সূচনা হয়। তখনকার সময় বাংলার সোনারগাঁও অঞ্চল ছিল মসলিন শিল্পের অন্যতম কেন্দ্র।

ঞ্চদশ শতকে বাংলাদেশে আসা চীনা লেখকরা ও এখানকার সুতি বস্ত্রের ভুয়সী প্রশংসা করেন। মোগল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল' পর্যন্ত সোনারগাঁওয়ে প্রস্তুতকৃত এই সুক্ষ্ম সুতি বস্ত্রের প্রশংসা করতে ভুলেন নি। এভাবে সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকাকে বাংলার রাজধানী ঘোষণার পর থেকেই ইউরোপিয় ব্যবসায়ীরা বাংলায় আসা শুরু করেন।

১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজরা ক্ষমতাকে তাদের হস্তগত করে ফেলার পর আস্তে আস্তে মসলিন বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করে এবং একটা সময় মসলিন হারিয়ে যায়।

ঢাকার পাশে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়াতে ফুটি কার্পাস নামে একধরনের বিশেষ তুলা গাছ উৎপন্ন হতো। সেই গাছের তুলা থেকে পাওয়া যেত একধরনের বিশেষ সুতা। সেই সুতাকে আবার মিহি আর মসলিন তৈরির উপযুক্ত করে তোলার জন্য বোয়াল মাছের দাঁত আর বাঁশের ধনু দিয়ে পরিষ্কার করার পর চরকায় কাটা হতো। কারিগরেরা ধাপে ধাপে মসলিন বোনার প্রক্রিয়া মনে রাখার জন্য বিভিন্ন শ্লোক বা ছন্দ মনে রাখতেন। এইসব তাঁতীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ভালোবাসায় তৈরি হতো একেকটি মসলিন। একেকটি স্বপ্ন, একেকটি আনন্দঘন মুহূর্ত।

মসলিন বিশেষ এক ধরনের তুলার আঁশ থেকে তৈরি সূতা, যা দিয়ে তাঁতের সাহায্যে বুনন করা এক প্রকারের খুব সূক্ষ্ম কাপড়, এইটাই ঢাকাই মসলিন নামে পরিচিত। ফুটি কার্পাস তুলা থেকে তৈরি অতি চিকন সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি করা হত। চড়কা দিয়ে কাটা, হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হত যার ফলে মসলিন হত কাচের মত স্বচ্ছ। এই মসলিন রাজকীয় পোশাক নির্মাণে ব্যবহার করা হত। মসলিন প্রায় ২৮ রকম হত যার মধ্যে জামদানি অন্যতম এবং এখনও ব্যাপক আকারে প্রচলিত।

মসলিন মূলত ঢাকা এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে তৈরি হতো। মসলিন তৈরির জন্য শীতলক্ষ্যার পাড়ের আবহাওয়া ছিলো সবচেয়ে উপযুক্ত। মসলিনে সুতা এতই সূক্ষ্ম ছিলো যে সকাল কিংবা সন্ধ্যাবেলার শীতল আর স্নিগ্ধ পরিবেশ ছাড়া এই সুতা কাটাই যেতো না। অনেকে মনে করেন, ১৮ থেকে ৩০ বছরের মেয়েরাই এই সুতা কাটতে পারতো।

আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক এই মসলিন এতটাই সূক্ষ্ম ছিলো যে কথিত আছে একটি আংটির ভেতর দিয়েই গলানো যেত গজের পর গজ কাপড়। সূক্ষ্মতা সম্পর্কে অনেকে বলে থাকেন, ৫০ মিটার মসলিন কাপড় নাকি একটা দেশলাইয়ের বাক্সে অনায়াসেই এঁটে যেতো!

আঠারো শতকে ঢাকাই মসলিন শিল্পের অবক্ষয় শুরু হয়। এর কারণ ছিল ইংরেজদের শাসন। ইংরেজরা বাংলার মসলিন শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। তারা মসলিন শাড়ির উপর উচ্চ শুল্ক চাপায় এবং মসলিন শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।

উনিশ শতকে ঢাকাই মসলিন শিল্পের আরও অবক্ষয় ঘটে। এর কারণ ছিল ব্রিটিশদের ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে মসলিন শাড়ি আমদানি। ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে মসলিন শাড়ি আমদানি করে এবং কম দামে বিক্রি করত। এর ফলে স্থানীয় মসলিন শিল্পের পক্ষে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
 উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তৈরি আধা টুকরা একখানি মসলিন (১০গজ × ০১গজ) ১৮৫১ সালে বিলেতের প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়েছিল, এর ওজন ছিলো আট তোলা।

পাশাপাশি, ঢাকা জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত মসলিন খানির দৈর্ঘ্যও ১০ গজ এবং চওড়া ১ গজ, এর ওজন মাত্র ৭ তোলা। তাহলে ঢাকার মসলিন মোগল শিল্পের স্বর্ণযুগের চেয়ে যে আরো সুক্ষ্মভাবে তৈরি করা যেতো সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।।

ভারতে ব্রিটিশশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা কাপড়ের উপরে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়, যেখানে ব্রিটেনে প্রস্তুত করা আমদানিকৃত কাপড়ের উপরে মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ কর ছিল। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের তাঁতশিল্পে ধস নামে।

কথিত আছে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা মসলিন উৎপাদন বন্ধ করার জন্য মসলিন বয়নকারী তাঁতিদের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে দেয়। তবে অধুনা অন্য আরেকটি দাবি বেশ যৌক্তিকভাবে সামনে উঠে এসেছে।তা হল, তাঁতিদের আঙ্গুল ব্রিটিশরা নয়, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের আঙ্গুল কেটে ফেলেছিল, যাতে এই তাঁতের কাজ আর না করতে হয়।

মূলত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা, বাজার ধ্বস, কাঁচামালের অপ্রাপ্যতা, জলবায়ু পরিবর্তন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে সম্পূর্ণভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যায় মসলিন। এখন শুধু জাদুঘরেই এর দেখা মেলে।

২০ শতকে ঢাকাই মসলিন শিল্পের আবারও পুনরুজ্জীবন ঘটে। এর কারণ ছিল বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ। বাংলাদেশ সরকার ঢাকাই মসলিন শিল্পকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। তারা মসলিন শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করে এবং মসলিন শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেয়। রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের পরিচালক ও বায়োটেকনোলজি গবেষক অধ্যাপক ড. মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল এ নিয়ে কাজ করছেন। চলছে ফুটি কার্পাস গাছের অনুসন্ধান। সেই দেয়াশলাইয়ের বাক্সে আঁটবে এমন মসৃণ মসলিন তারা তৈরি করতে পারবেন, এমনটা না যদি নাও হয়, তবু তাদের আশা আদি মসলিনের কাছাকাছি মসলিন তৈরি করা নিশ্চয়ই সম্ভব হবে।

এছাড়াও সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে কাজ চলছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় জাদুঘরে আড়ং, দৃক গ্যালারি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মাসব্যাপী মসলিন উৎসবের আয়োজন করা হয়। এতে মসলিনের হারানো ঐতিহ্য, ইতিহাস মানুষের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি প্রদর্শিত হয় মসলিনের কাছাকাছি তৈরি কাপড়ের ফ্যাশন শো।

মসলিন আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের অহংকার। আমাদের জাতিসত্তার একটি অংশ। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে নিশ্চয়ই মসলিন একদিন তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে । সেদিন হয়তো মসলিন দিয়েই বাংলাদেশকে আবার নতুন করে চিনবে বিশ্ব।

বর্তমানে ঢাকাই মসলিন শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ঢাকাই মসলিন তার সূক্ষ্মতা ও মানের জন্য বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত। ঢাকাই মসলিন শাড়ি এখনও বাংলার ঐতিহ্যবাহী পোশাক হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশের তাঁত বোর্ড (বাতাঁবো) ঢাকাই মসলিনকে জি-আই- পন্য হিসাবে নিবন্ধন করার জন্য ডিপিডিটির কাছে আবেদন করলে সেটি ২০২০ সালে স্বীকৃতি পায়।