ঢাকা প্রেস নিউজ
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধকে সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, অনেক সময় নির্যাতনের শিকার নারীরা জানেন না কোথায় অভিযোগ জানাতে হবে। এ সমস্যা সমাধানে হটলাইন চালু করা হয়েছে, যাতে তারা সহজেই অভিযোগ জানাতে পারেন। এছাড়া, আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে সরকার পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ হালনাগাদ করার পাশাপাশি যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন, ২০২৫ প্রণয়ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। নারীদের কল্যাণে একটি বিশেষ সংস্কার কমিশনও গঠন করা হয়েছে, যা গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ প্রদান করবে।
আজ শনিবার (৭ মার্চ), আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২৫ উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের অগ্রণী ভূমিকার কথা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সমাজের অনেকক্ষেত্রে এখনো নারীরা পিছিয়ে আছে। তবে নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে সরকার সর্বদা সচেষ্ট। দুঃস্থ মায়েদের আর্থিক সহায়তা, নারীদের প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, কর্মজীবী নারীদের জন্য হোস্টেল ও ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠার মতো বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়েও আলোচনা চলছে।
নারী নির্যাতনের সাম্প্রতিক ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের স্বপ্নের পরিপন্থী। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, "আমরা নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সর্বশক্তি দিয়ে তা বাস্তবায়ন করব।" বাংলাদেশের নারীরা সাহসিকতার সঙ্গে রাজনীতি, অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখছেন।
সম্প্রতি দেশজুড়ে আয়োজিত ‘তারুণ্যের উৎসব ২০২৫’-এ রেকর্ডসংখ্যক নারী ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল ও বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করেছেন। এই উৎসবে ২৭ লাখ ৪০ হাজার নারী প্রায় তিন হাজার খেলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। দর্শকদের বিপুল উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের সমাজে নারীর অধিকার ও অংশগ্রহণ প্রতিষ্ঠায় পুরুষদেরও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন রয়েছে।
নারীবিরোধী যে কোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “নারীকে খাটো করে দেখার মানসিকতা বদলাতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তা না হলে জাতি হিসেবে আমরা কখনোই এগিয়ে যেতে পারব না।”
তিনি আরও বলেন, পতিত স্বৈরাচার দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামাজিক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে এবং সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।
অধ্যাপক ইউনূস স্মরণ করিয়ে দেন, আজকের বিশ্বে নারীরা যে অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করছেন, তা সংগ্রামের মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা হয়েছিল নিউইয়র্কের নারী শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশেও নারীরা যুগে যুগে সংগ্রাম করেছেন—তেভাগা আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে তারা অসামান্য অবদান রেখেছেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নারীদের সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি, তাতে নারীদের সমান অংশগ্রহণ ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাই পুরুষদেরও নারীদের সহযোগী হতে হবে। নতুন বাংলাদেশে আমরা এমন একটি পরিবার গড়ে তুলতে চাই যেখানে সকলের অধিকার নিশ্চিত থাকবে।"
নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগাব। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়বই—এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।"
বক্তব্যের শুরুতে তিনি আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী, গৃহিণীসহ সকল নারীর প্রতি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ-বীরাঙ্গনাদের, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের এবং সংগ্রামী নারীদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন।