বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন এখন মানবসভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বরফ গলন, সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা, অতিবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় আজ প্রায় নিয়মিত ঘটনা। এর পেছনে মূল দায়ী মানবসৃষ্ট কার্বন নির্গমন। শিল্পায়ন, জ্বালানি ব্যবহার, বন উজাড় ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন মিলিয়ে বায়ুমণ্ডলে ক্রমেই বাড়ছে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে জলবায়ু চক্র। এই সংকট থেকে উত্তরণের অন্যতম পথ কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন। অর্থাৎ যতটুকু কার্বন নিঃসরণ করা হবে, ঠিক ততটুকু কার্বন আবার প্রকৃতি দ্বারা শোষিত হবে। এই লক্ষ্যেই বিশ্বব্যাপী “কার্বন নিউট্রাল পলিসি” আজ টেকসই উন্নয়নের কেন্দ্রে স্থান পেয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে এক অনন্য ও অনুপ্রেরণাদায়ী ঘটনা ঘটেছে। এক নবজাতককে দেশের প্রথম কার্বন নিউট্রাল শিশু হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আয়ান খান রুহাব নামের এই শিশুটি এখন পরিবেশ সচেতনতার প্রতীক। তার বাবা-মা সন্তানের জন্ম উপলক্ষে রোপণ করেছেন ৫৮০টি গাছ। তাঁদের লক্ষ্য সন্তানের জীবনের পুরো সময়জুড়ে আয়ান যতটুকু কার্বন নিঃসরণ করবে, তা প্রকৃতি যেন নিজের ভিতরে ধারণ করতে পারে। পরিবেশ গবেষকদের হিসাবে, একজন মানুষ বছরে গড়ে প্রায় ১ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) নিঃসরণ করে। অথচ আয়ানের নামে রোপিত এই ৫৮০টি গাছ বছরে প্রায় ১১ টন কার্বন শোষণ করতে সক্ষম। অর্থাৎ, শিশুটি প্রকৃত অর্থেই কার্বন নিরপেক্ষ, বরং প্রকৃতির জন্য ‘কার্বন পজিটিভ’ এক উদাহরণ—যেখানে প্রকৃতি তার মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে।
গাণিতিক বিশ্লেষণ: একজন মানুষের কার্বন নির্গমন ও গাছের ভূমিকা
একজন মানুষ বছরে গড়ে ১ টন (অর্থাৎ ১,০০০ কেজি) কার্বন নিঃসরণ করলে, সেটি শোষণের জন্য প্রয়োজন হবে প্রায় ৫০টি গাছ (যদি প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে গড়ে ২০ কেজি CO₂ শোষণ করে ধরে নেওয়া হয় তাহলে, ১,০০০ ÷ ২০ = ৫০টি গাছ)। এখন যদি একজন মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছর হয়, তবে জীবদ্দশায় মোট কার্বন নিঃসরণ হবে: ৭০ × ১,০০০ = ৭০,০০০ কেজি (অর্থাৎ ৭০ টন)। এই ৭০ টন কার্বন শোষণের জন্য প্রয়োজন হবে: ৭০,০০০ ÷ ২০ = ৩,৫০০টি গাছ। অর্থাৎ, একজন মানুষ তার জীবনের নির্গমন শোষণ করতে অন্তত ৩,৫০০টি গাছ লাগাতে পারেন। অন্যদিকে, আয়ান রুহাবের পরিবারের রোপণ করা ৫৮০টি গাছ যদি বছরে ১১ টন কার্বন শোষণ করে, তাহলে প্রতিটি গাছ শোষণ করছে প্রায় ১৯ কেজি CO₂, যা আন্তর্জাতিক গড়ের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই হিসেবে দেখা যায়, একজন সাধারণ মানুষের কার্বন নির্গমন সমান করতে যেটুকু বৃক্ষরোপণ প্রয়োজন, আয়ানের পরিবার তার দশগুণ বেশি করেছে। তাঁরা শুধু নিজের সন্তানের নয়, অন্য মানুষের জীবনবায়ুও পরিচ্ছন্ন রাখছেন।
কার্বন নিউট্রাল নীতির মূল দর্শন:
“কার্বন নিউট্রাল পলিসি” হলো এমন এক পদ্ধতি, যেখানে উৎপাদিত কার্বন ও শোষিত কার্বনের পরিমাণ সমান রাখা হয়। এই ভারসাম্য অর্জনের জন্য কয়েকটি কৌশল অনুসরণ করা হয়। ১. নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার (সৌর, বায়ু, জলবিদ্যুৎ ইত্যাদি), ২. শিল্প ও পরিবহনে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি, ৩. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পুনর্ব্যবহার, ৪. বৃক্ষরোপণ ও বন সংরক্ষণ। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপানসহ বহু দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ হওয়ার অঙ্গীকার করেছে। ভারত ২০৭০ সালকে লক্ষ্য ধরেছে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই; সরকার ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছে “ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান (২০২২–২০৪১)”, যেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সবুজ বিনিয়োগ ও কার্বন হ্রাসকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। পরিবর্তন শুরু করতে হবে নাগরিক পর্যায়ে। আয়ান রুহাবের পরিবারের উদ্যোগ সেই ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা প্রমাণ করে একটি ছোট পদক্ষেপও বড় পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে পারে।
নাগরিক উদ্যোগ: ছোট প্রয়াসে বড় পরিবর্তন
বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষ যদি বছরে মাত্র একটি করে গাছ রোপণ ও পরিচর্যা করে, তবে বছরে ১৭ কোটি নতুন গাছ যুক্ত হবে আমাদের পরিবেশে। ধরুন, প্রত্যেকে যদি পাঁচটি করে গাছ লাগায়, তবে দেশজুড়ে ৮৫ কোটি গাছ তৈরি করবে এক সবুজ বিপ্লব। এত বিপুল গাছ বছরে শত কোটি টন কার্বন শোষণ করতে পারবে যা দেশের মোট নির্গমনকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে। কিন্তু শুধু গাছ লাগানোই যথেষ্ট নয়; লাগানো গাছকে বাঁচিয়ে রাখা আরও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি আয়োজনের পর গাছগুলোর আর কোনো খোঁজ থাকে না। তাই টেকসই ফল পেতে হলে রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও স্থানীয় প্রজাতি বাছাই সবকিছু সমন্বিতভাবে করতে হবে। গাছকে কেবল প্রতীক হিসেবে নয়, জীবনধারণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভাবতে হবে।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দায়িত্ব:
কার্বন নিরপেক্ষ জীবনধারা শুরু হতে পারে ঘর থেকেই। ঘরের বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতনতা, প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো, গণপরিবহন বা সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহ, বর্জ্য আলাদা করে ফেলা, নিয়মিত বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি পদক্ষেপ একটি সমাজকে কার্বন হ্রাসের পথে নিয়ে যেতে পারে। আয়ান রুহাবের পরিবার দেখিয়ে দিয়েছে, পরিবর্তনের সূচনা একজন মানুষ থেকেই সম্ভব।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা:
বাংলাদেশের ভূগোল ও আবহাওয়া বৃক্ষরোপণের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ, গ্রামীণ অঞ্চলে ফলজ ও বনজ গাছ, শহরে ছায়া ও সৌন্দর্যবর্ধক গাছ সব মিলিয়ে আমরা যদি পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষরোপণ করি, তবে তা শুধু কার্বন নিরপেক্ষতায় নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে শুধু কার্বন শোষণই করে না, বরং অক্সিজেন উৎপন্ন করে, মাটি দৃঢ় রাখে, ছায়া দেয় এবং জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে রাখে।
টেকসই ভবিষ্যতের পথে:
কার্বন নিরপেক্ষতা কেবল পরিবেশ রক্ষার নীতি নয়। এটি মানবতার টিকে থাকার শর্ত। আয়ান রুহাবের জন্মের মাধ্যমে তাঁর বাবা-মা যেভাবে সবুজ প্রতীক স্থাপন করেছেন, তা প্রমাণ করে টেকসই ভবিষ্যৎ শুরু হয় পরিবার থেকেই। আজ যদি প্রতিটি পরিবার এভাবে নিজের দায়বদ্ধতা অনুভব করে, তাহলে কার্বন নিউট্রাল বাংলাদেশ কল্পনা নয়, বাস্তবতা হবে। আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজের নির্গমনের দায় বুঝে, প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য রেখে বাঁচতে শেখা।প্রকৃতি আমাদের শত্রু নয়; সে কেবল তার ভারসাম্য ফিরিয়ে নিতে জানে। সময় এখন সবুজ চিন্তার, সবুজ কাজের, সবুজ নীতির। ছোট্ট আয়ান রুহাবের মতো প্রতিটি শিশুর ভবিষ্যৎ যেন থাকে নির্মল ও টেকসই এই দায়িত্ব আজ আমাদের সবার।

লেখক:
আলম-গীর হোসেন,
উপদেষ্টা, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা,
উপ-দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, কেন্দ্রীয় কমিটি,
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।