গতকাল শুক্রবার রাজধানীসহ সারা দেশে যে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, এর উৎপত্তিস্থল সিলেটের গোলাপগঞ্জ। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৫। আজকের ভূমিকম্পের এই উৎপত্তিস্থলের এলাকা দেশের সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এখানে ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বড় বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস আছে। ভূমিকম্প–গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, আজকের ভূমিকম্প ছোট মাত্রার। এ অঞ্চলে সেটা বারবার সংঘটিত হয়ে আসছে। ভূমিকম্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই এলাকা ভারত-বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। অর্ধশতাব্দী পরপর এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প আঘাত হানে। যেমন ১৮৬৯, ১৮৯৭, ১৯১৮, ১৯৫০ সালে এই সক্রিয় ভূতাত্ত্বিক প্লেট অঞ্চলে বড় বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল। এ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল ‘আসাম সিনটেকসিস’ নামে পরিচিত। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আঘাত হানা তুরস্কের ভূমিকম্পটি অনুরূপ সক্রিয় ভূতাত্ত্বিক অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল।
সিলেটের সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে টেকটোনিক কাঠামোর কারণেই সেখানে একাধিক চ্যুতি আছে বলে জানান অধ্যাপক মাকসুদ কামাল। এর মধ্যে ডাউকি চ্যুতি খুব বড়। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় চ্যুতিগুলোর এটি একটি। এর বিস্তৃতি পূর্ব–পশ্চিমে ৩০০ কিলোমিটার। ডাউকির নাম হয়েছে মেঘালয়ের একটি শহরের নাম থেকে। এই চ্যুতি বাংলাদেশের দিকে চলে এসেছে। এটি ভূমিকম্পের একটি বড় উৎস।
এ চ্যুতিতে ১৮৯৭ সালে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়। এটি ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। সেটি ছিল এক ভয়াবহ ভূমিকম্প। এতে মেঘালয় এলাকা একেবারে পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ১৮৯৭ সালে যে ভূমিকম্প হয়েছিল, সেখানে উৎপত্তিস্থলে রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৩। কিন্তু রাজধানী ঢাকা সেই উৎপত্তিস্থল থেকে ছিল প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দূরে। সেই ভূমিকম্পে ঢাকায় ৭ থেকে ৮ তীব্রতার বেশি ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে।
আজ যেখানে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল, সেখানে ছোটখাটো ভূমিকম্পের রেকর্ড আছে। এই ভূমিকম্প বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে প্লেট বাউন্ডারির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত একটি সক্রিয় চ্যুতি অঞ্চলে সংঘটিত হয়। সক্রিয় এ চ্যুতি সিলেটের পূর্বাঞ্চল থেকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর বিস্তৃতি প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার। ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গলের ভূমিকম্পটি আজকের ভূমিকম্পের কাছাকাছি রশিদপুর চ্যুতিতে সংঘটিত হয়েছিল, যার মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬।
অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় অঞ্চলে ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়ার অর্থ এখানকার ভূ–অভ্যন্তরে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে মাঝেমধ্যে। তবে ভূ–অভ্যন্তরস্থল প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে আছে। ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় এই প্লেট বাউন্ডারি ও চ্যুতি অঞ্চলের ছোটখাটো ভূমিকম্প ইঙ্গিত দেয়, আরও কোনো বড় ভূমিকম্প আসতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো, এসব ভূমিকম্পের প্রভাব ঢাকার ওপর কতটা পড়বে? অধ্যাপক মাকসুদ কামালের বক্তব্য, ১৮৯৭ ও ১৯১৮ সালে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল, তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল এখনকার তুলনায় একেবারেই কম। আজকের তুলনায় তখনকার শহর তো একেবারে ছোট ছিল। আজকের সময়ে ওই অঞ্চলে যদি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তবে এর প্রভাব পড়বে ঢাকায়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের তীব্রতা ঢাকায় ৭-৮ অনুভূত হয়, আজকের ঢাকার বাস্তবতা এই তীব্রতার ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে অকল্পনীয়। ভূমিকম্প অনেক দূরে তথা ঢাকা থেকে ২০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে সংঘটিত হলেও ঢাকার ভূগাঠনিক অবস্থা, বিস্তৃত অঞ্চলে নরম মাটি ও দুর্বল অবকাঠামো হওয়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতি আরও বেড়ে যাবে।