ভারতে খাদ্যের ক্রমবর্ধমান দাম কেন পুরো বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ
প্রকাশকালঃ
২৯ আগu ২০২৩ ০৬:৫০ অপরাহ্ণ ২১৫ বার পঠিত
ভারতে খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রভাব বুঝতে গেলে ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁয় যাওয়া যেতে পারে। দেখা যাবে, সাবওয়ের স্যান্ডউইচের ওপর বিনা পয়সায় যে পনিরের টুকরা দেওয়া হতো, সেটা উধাও হয়ে গেছে। ম্যাকডোনাল্ডস ও বার্গার কিংয়ের বার্গার থেকে হারিয়ে গেছে টমেটো। স্থানীয় সব রেস্তোরাঁয় টমেটোভিত্তিক সব খাবারের দাম বেড়ে গেছে।
খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভারত সরকার রপ্তানি সীমিত করার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে ভারতের ভোক্তাদের সুবিধা হলেও খাদ্য আমদানিকারক দেশগুলোর মানুষেরা বিপাকে পড়তে পারে বলে জানাচ্ছে দ্য ইকোনমিস্ট।
জুলাইয়ে ভারতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সবজির দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। কিছু কিছু পাইকারি বাজারে টমেটোর দাম গত ৩ মাসে ১ হাজার ৪০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। সব মিলিয়ে জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার গত ৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৫ শতাংশে উঠেছে। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হারও ১৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ—৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
মূলত খাদ্যের এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ হচ্ছে আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণ। ভারী বৃষ্টির কারণে ভারতের অনেক অঞ্চলে কৃষিজমি তলিয়ে গেছে, ব্যাহত হয়েছে সরবরাহব্যবস্থা। আবার আরেক দিকে দাবদাহের কারণে ফসলহানি হয়েছে।
জুলাইয়ের শেষ দিকে এসে দেখা গেল, ফসলের জন্য কৃষকদের যে পরিমাণ বীজ রোপণ করার কথা, তার চেয়ে অন্তত ৪০ শতাংশ কম রোপিত হয়েছে। এখন আবার আগস্টে বৃষ্টি নেই। বিষয়টি অস্বাভাবিক, তাতে ফসলহানি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। জানা গেছে, চলতি মাসে ভারতে এক শতকের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে।
তবে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া আতঙ্কিত হয়নি। চলতি মাসের ১০ তারিখে মুদ্রানীতি কমিটির বৈঠকে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, এ নিয়ে এপ্রিলের পর টানা তিনবার নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখা হলো। আরবিআইয়ের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস মনে করেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাময়িক। তাঁর আশা, সেপ্টেম্বর থেকেই খাদ্যের দাম কমতে শুরু করবে।
তবে কোনো কোনো বিশ্লেষক শক্তিকান্ত দাসের এই অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সবজির দাম বেড়ে যায়, এরপর তা কমতে শুরু করে। কিন্তু এবার কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, এবারের খাদ্য মূল্যস্ফীতির ধারা দীর্ঘস্থায়ী হবে।
বোধগম্য কারণেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই অবস্থান নিয়েছে। সামনে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন—আগামী বছর জাতীয় বা লোকসভা নির্বাচন। এই পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হোক, সেটা ক্ষমতাসীনেরা চায় না। যদিও গত সপ্তাহে প্রকাশিত জাতীয় জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৫৯ শতাংশ মানুষ মনে করছে সরকার ঠিকপথে আছে, জানুয়ারি মাসে যা ছিল ৬৭ শতাংশ।
এই পরিস্থিতিতে খাদ্যে ভর্তুকি দিয়ে জনমত ঘোরাতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ১২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার বরাদ্দ দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার খাদ্য রপ্তানি সীমিত করেছে। অভ্যন্তরীণ মজুত ধরে রাখা ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ২৫ আগস্ট সেদ্ধ চাল রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে তারা। এর আগে গত ২১ জুলাই অবাসমতী সাদা চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল দেশটি। ওই নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য ছিল অভ্যন্তরীণ সরবরাহ বাড়ানো ও আসন্ন উৎসব মৌসুমের সময় চালের খুচরা দাম নিয়ন্ত্রণ করা। ভারত যত চাল রপ্তানি করে তার প্রায় ২৫ শতাংশ অবাসমতী সাদা চাল। তারও আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল ভারত।
এখানেই শেষ নয়, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। বিশ্ববাজারে ভারত যে পরিমাণ চাল রপ্তানি করে, তা রপ্তানি বাজারের ৪০ শতাংশের বেশি। ফলে তারা চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় অন্য আমদানিকারক দেশে চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ বাড়তে পারে।
কিন্তু এসবের জেরে বিশ্ববাজারে ইতিমধ্যে দাম বেড়েছে। ভারত চাল রপ্তানি সীমিত করার পর ইতিমধ্যে বিশ্ববাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে। এতে কোটি কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ, বিশ্বের ৮০ ভাগ মানুষ যেসব দেশে বসবাস করে, তারা যত না খাদ্য রপ্তানি করে, তার চেয়ে বেশি আমদানি করে। তবে আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণের জেরে ভারতের মতো দেশে এমন পরিস্থিতি আবারও সৃষ্টি হতে পারে, তখন তারা আবারও রপ্তানি সীমিত করবে।