আনোয়ার সাঈদ তিতু , কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
কুড়িগ্রাম কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি)’তে একটি চক্র সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গড়ে তুলেছে প্রতারণার নতুন নতুন ফাঁদ। দীর্ঘদিন ধরে এই চক্রটি প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতি করলেও ভুক্তভোগীরা রেহাই পাচ্ছে না এদের হাত থেকে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করলেও কোন প্রতিকার না পাওয়ায় আরও বেপরোয়া দুর্নীতিবাজ চক্রটি।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে গত ২০/০৪/২৫ তারিখে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই অধ্যক্ষ আবু সৈয়দ মো. রেজাউল করিম খন্দকার একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতি করে হাতিয়ে নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ টাকা। অর্থ না দিয়ে তার প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করা বা ঠিকাদারী করা অসম্ভব ব্যাপার। তার কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করায় বেরিয়ে পরছে থলের বেড়াল। পাহার সমান অভিযোগের খড়গ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগকারীরা জানান, ত্রæটিপূর্ণ টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ৫টি ট্রেডের সাড়ে ১২ লক্ষ টাকার মালামাল ক্রয় না করেই তিনি আত্মসাৎ করেছেন। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সরবরাহকারীর কাছ থেকে গ্রহনকৃত ২০ লাখ টাকার জামানাতের চেক ফেরৎ দিতে করছেন তালবাহানা, ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন ৭/৮লক্ষ টাকা। এছাড়াও টিটিসিতে কর্মরত ৮ সাপোর্ট স্টাফদের কাছ থেকে অবৈধ অর্থ সুবিধা নিতে না পেরে বেআইনীভাবে চাকুরিচ্যুত করিয়ে নতুনভাবে নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধ্যক্ষ আবু সৈয়দ মো. রেজাউল করিম জয়পুরহাট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে ওই প্রতিষ্ঠানের গার্মেন্টস ট্রেডের ইন্সট্রাক্টর মুক্তাদুর রহমান খন্দকারের সাথে যোগসাজস করে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গেস্ট ইন্সট্রাক্টর পদে ৫জন যুবককে নিয়োগপত্র প্রদান করে অনৈতিকভাবে ৭ থেকে ৮ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন। আবেদনকারীদের স্থায়ীভাবে নিয়োগের কথা বলা হলেও পরবর্তীতে বিষয়টি জানাজানি হলে নিয়োগকৃপ্রাপ্তরা ঘুষের টাকা ফেরৎ চাইতে গেলে চক্রটি ভুক্তভোগীদের মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়াসহ প্রাণনাশের হুমকী ধামকী দিয়ে তাড়িয়ে দেন।
পরবর্তীতে সংক্ষুব্ধরা মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহন করায় চতুর অধ্যক্ষ আবু সৈয়দ মো. রেজাউল করিম খন্দকার এবং ইন্সট্রাক্টর মুক্তাদুর রহমান খন্দকার অভিযুক্তদের কন্ঠরোধ করতে কিছু অর্থ নিজেদের কাছে রেখে বাকী অর্থ ফেরৎ দেন। এরপরেই আবার একই পদ্ধতিতে মোটা অংকের ঘুষ গ্রহনের মাধ্যমে নতুনভাবে লোক নিয়োগ করার খবরটি উর্ধ্বতন কর্তপক্ষের নজরে আনা হলেও অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
ভুক্তভোগীরা অসৎ এই চক্রের হোতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। জুলাই আন্দোলনের স্প্রিটকে বিনষ্ট করার জন্য সাবেক ফ্যাসিস্টের দোসর এই চক্রটি বহাল তবিয়তে তাদের পদে থেকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে।
এদিকে কুড়িগ্রাম টিটিসির ১০টি ট্রেডে ৫০ লক্ষ টাকার কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে জনৈক ঠিকাদার হুমায়ুন কবীরের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে দুই দফায় তার কাছ থেকে ১৫ লক্ষ ও ৫ লক্ষ টাকার জামানতের দুটি চেক গ্রহন করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু সৈয়দ মো. রেজাউল করিম খন্দকার। এরপর বিভিন্ন ট্রেডে কাচামাল সংগ্রহের কথা বলে হুমায়ুন কবীরের কাছ থেকে আরও সাড়ে ১২ লক্ষ টাকা নগদ ক্যাশ গ্রহন করেন। এরমধ্যে মালামাল ক্রয়ের জন্য ১০ লক্ষ টাকা এবং মূল্যায়ন কমিটিকে ম্যানেজ করার নামে আড়াই লক্ষ টাকা বাগিয়ে নেন।
চতুর অধ্যক্ষ জালিয়াতির মাধ্যমে গত ২২/০৪/২৪ইং তারিখে গোপনে দুটি টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পাদন করেন। এরমধ্যে একটি দরপত্রে মেসার্স আব্দুল মালেককে সবনি¤œ দরদাতা দেখিয়ে ৩টি কাজ এবং অপরটিতে মেসার্স রুহুল আমিন ট্রেডার্সকে সর্বনি¤œ দরদাতা দেখিয়ে ২টি কাজ দেয়া হয়। দুই মাস পর বিগত ১৬/০৬/২৫ইং তারিখে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ৯ লাখ এবং ৬ লাখ টাকার বিলে ভ্যাট ও আয়কর কর্তন করে মোট ১২লাখ ৯৮ হাজার টাকার দুটি চেক হুমায়ুন কবীরের হাতে তুলে দেন টিটিসি’র অধ্যক্ষ।
এসময় তিনি ঠিকাদার হুমায়ুন কবিরের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ও ভাগ্নেকে সরকারি চাকুরী প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে নগদ ৫ লক্ষ টাকা ও ৮ লক্ষ টাকার চেকসহ ১৩ লক্ষ টাকা ঘুষ গ্রহন করেন।
দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও ১০টি ট্রেডের মালামাল ক্রয় ও চাকুরীর বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখায় ঠিকাদার হুমায়ুন কবীরের মধ্যে সন্দেহ হলে কাজের জন্য অধ্যক্ষকে চাপ দেয়া শুরু করেন। এতে ক্ষীপ্ত হয়ে অধ্যক্ষ আবু সৈয়দ মো. রেজাউল করিম খন্দকার ঠিকাদার হুমায়ুন কবীরকে অফিস থেকে তাড়িয়ে দেন।
ঠিকাদার আব্দুল মালেক সাংবাকিদের জানান, টিটিসি কর্তৃপক্ষ আমার ঠিকাদারী লাইসেন্স দিয়ে জনৈক হুমায়ুন কবীরকে কাজ পাইয়ে দিয়েছে বলে জেনেছি। তবে, আমি কোন মালামাল সরবরাহ করিনি এবং কোন চেক গ্রহন করিনি। তিনি আরও স্বীকার করেন আমার লাইসেন্সটি সরবরাহকারীর নয়। তারপরও কিভাবে দরদাতা হিসেবে সিলেক্ট করা হয়েছে সেটি টিটিসি কর্তৃপক্ষ ভাল বলতে পারবেন।
এদিকে চাকুরীচ্যুত বাবুর্চী আবু সাঈদ ও সহকারি বাবুর্চী সুমন লিখিত অভিযোগে জানান, আমরা টিটিসির আবাসিক ছাত্রাবাসে রান্নার কাজ করি। অধ্যক্ষ স্যার অফিসে যোগদান করার পর আমাদেরকে অফিসে ডেকে মৌখিকভাবে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করেন।
আমরা কারণ জানতে চাইলে তিনি অটোমেটিক ট্রেডের ইন্সট্রাক্টর গৌতম স্যারের সাথে দেখা করতে বলেন। গৌতম স্যার আমাদেরকে রেজাউল করিম স্যারের জন্য ১লক্ষ টাকা প্রদান করলে চাকুরী বলবৎ থাকবে বলে জানান। আমরা টাকা প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে গত ১৬/০৫/২৫ইং তারিখে আমাদেরকে জোর করে অফিস থেকে বের করে দেয়া হয়। আমরাসহ মোট ৮জন সাপোর্ট স্টাফকে চাকুরী থেকে বহিস্কার করা হয়েছে বলে তারা সাংবাদিকদের জানান।
জয়পুরহাট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গেস্ট ট্রেইনার (অটোমেটিক মেকানিক্স) পদে চাকুরী হয় ওই প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী মোতাইব হোসেন’র। তিনি লিখিত অভিযোগে জানান, স্থায়ী চাকুরীর কথা বলে তৎকালীন অধ্যক্ষ আবু সৈয়দ মো. রেজাউল করিম খন্দকার স্যার গার্মেন্টস ট্রেডের ইন্সট্রাক্টর মুক্তাদুর রহমান খন্দকারের মাধ্যমে আমার পরিবারের কাছ থেকে ২ লক্ষ টাকা গ্রহন করেন। পরে ভুয়া নিয়োগে চাকুরীর বিষয়টি জানতে পেরে টাকা ফেরৎ চাইলে আমাকে দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে গলা ধাক্কা দেয়া হয়।
এদিকে ভুক্তভোগী ঠিকাদার হুমায়ুন কবীর জানান, অধ্যক্ষের মিষ্টি কথায় তার প্রলোভনে পরে যাই। তিনি আমাকে প্রথম দফায় ৫টি ট্রেডের কাজ পাইয়ে দেন। তবে অফিস মারফত জানতে পেরেছি পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়াটি ছিল অস্বচ্ছ। সরবরাহকারী নয় এমন প্রতিষ্ঠানকে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচন করা হয়েছে। এছাড়াও মালামাল সরবরাহের চুক্তি থাকলেও এখন পর্যন্ত কোন মালামাল অফিস সংগ্রহ করেনি। এনিয়ে অধ্যক্ষ মহোদয়কে জানালে তিনি হেসে বলেন, আপনি মালামাল নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমরা কর্তৃপক্ষকে মালামাল গুদাম থেকে চুরি হয়েছে বলে জানাবো। তার এ ধরণের কথাবর্তা শুনে আমি বুঝতে পারি একজন বড় ধরণের প্রতারকের ফাঁদে পা দিয়েছি। পরে আমি তাকে জামানতের ২০ লক্ষ টাকা এবং আমার দুজন আত্মীয়কে চাকুরী প্রদানের নামে গ্রহনকৃত ১৩ লক্ষ টাকা চাইতে গেলে আমার সাথে খারাপ আচরন করেন। আমি প্রতিবাদ করলে তিনি আমাকে একপ্রকার অফিস থেকে তাড়িয়ে দেন। আমি এখন ৩৩লক্ষ টাকা ফেরৎ পেতে দুর্নীতি দমন সংস্থাসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেও এখন পর্যন্ত কোন প্রতিকার পাইনি।
এ ব্যাপারে টিটিসির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবু সৈয়দ মো. রেজাউল করিম খন্দকার চেক লেনদেনের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমি ঠিকাদার হুমায়ুন কবীরকে কোন কাজ পাইয়ে দেইনি। অফিস কর্তৃক নিয়ম মাফিক টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের নামে বিল প্রদান করা হয়েছে। আমার সুনাম ক্ষুন্ন করতে বিরোধী পক্ষ এসব মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ তুলে ধরছে।
অভিযোগ পাওয়ার বিষয়ে কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বি,এম কুদরত-এ-খুদা জানান, আমার হাতে এখনো অভিযোগের কপি আসেনি। অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্লাহ ভুঁইয়ার কাছে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।