সিন্ডিকেট বাণিজ্যে জর্জরিত কক্সবাজার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র: স্বাস্থ্যসেবা নয়, যেন লুটপাটের আখড়া

  প্রিন্ট করুন   প্রকাশকালঃ ১৮ আগu ২০২৫ ১২:২৪ অপরাহ্ণ   |   ৪২ বার পঠিত
সিন্ডিকেট বাণিজ্যে জর্জরিত কক্সবাজার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র: স্বাস্থ্যসেবা নয়, যেন লুটপাটের আখড়া

নিজস্ব প্রতিবেদক:-


 

★ ‘বিনা বকশিসে সেবা নয়’—হাসপাতালের অলিখিত নিয়ম

★ ঔষধ নেই, সেবা নেই—শুধু লুটপাটের বেহাল চালচিত্র


স্বাস্থ্যসেবাকে পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হলেও কক্সবাজার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সেই নীতির যেন লেশমাত্র অবশিষ্ট নেই। সরকার ও দাতা সংস্থার বিশেষ বরাদ্দ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল থাকার পরও কেন্দ্রটি এখন দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অর্থ লুটপাটের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
 

সাধারণত গরীব ও মধ্যবিত্ত গর্ভবতী নারীদের বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালটি বর্তমানে রোগীদের কাছ থেকে খোলাখুলিভাবে অর্থ আদায় করছে। ছোট সার্জারির জন্য নেওয়া হচ্ছে ৫ হাজার টাকা, বড় সার্জারির জন্য ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এমনকি মৃত সন্তান জন্ম নিলেও টাকা না দিলে রোগীকে হাসপাতাল ছাড়তে দেওয়া হয় না—এমন অভিযোগও উঠেছে।
 

জানা যায়, প্রায় দেড় বছর আগে প্রতিষ্ঠানটিতে যোগ দেন মেডিকেল অফিসার ডা. সাদিক আল্লাম সাঈফ ও ডা. সিরাজাম মুনিরা। এরপর থেকেই বদলে যেতে থাকে চিত্র। অভিযোগ আছে, ডাক্তার-নার্স ও হাসপাতাল কর্মীদের নিয়ে গঠিত একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এখন পুরো স্বাস্থ্যসেবাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। রোগীদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে বকশিস, নাস্তা খরচ ও অন্য খাতে অতিরিক্ত অর্থ জোরপূর্বক অর্থ আদায়, অপারেশনের নামে অতিরিক্ত চার্জ, এবং নানাবিধ অনিয়ম যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।


সরজমিনে দেখা গেছে, রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন নার্স বা প্যারামেডিক কর্মীরা। জরুরি বিভাগের দায়িত্বে থাকা ফার্মেসির একজন মহিলা কর্মচারী রোগী দেখছেন এবং প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন। অন্যদিকে, দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক নিয়মিতভাবে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে হাসপাতালে আসেন এবং দুপুর গড়ানোর আগেই চলে যান। অধিকাংশ সময় তাকে দেখা যায় ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে ব্যস্ত থাকতে।
 

 একপাশে অবস্থিত কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ও  ঠিক অপর পাশেই কক্সবাজার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি। অতচ সদর হাসপাতালে একটা সিট খালি না থাকলেও মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি থাকে রোগি শুন্য। ২০ শয্যার বেশির ভাগ সিট খালী থাকে সব সময়। আবার সরকারি ভাবে ঔষধ বরাদ্ধ না থাকায় অধিকাংশ রোগীদের বাইরে থেকে ঔষধ কিনে এনে সেবা নিতে হয়। সরকার এবং দাতা সংস্থা কতৃক সকল সহযোগীতা ডাক্তার, ভিজিটর থেকে শুরু করে সমস্ত জনবল এবং অর্থ সব কিছু দেওয়া অব্যাহত থাকলেও কেন হাসপাতালটির এমন দূরবস্থা তা নিয়ে প্রশ্ন জনমনে।
 

 সাধারণ জনগণের দাবী সংশ্লিষ্ট ডাক্তার সহ অন্যান্যদের চরম গাফেলতী, খারাপ ব্যবহার, দায়িত্ব অবহেলা সহ পরিবার পরিকল্পনা, বিভাগের উদাসিনতা এর জন্য দায়ী। তাই দ্রুত কক্সবাজার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের সমস্ত সেবার মান বাড়ানোর দাবী জানিয়েছে কক্সবাজারের সচেতন মহল।
 

মহেশখালী কুতুবজোম ২ নং ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি মোস্তাক জানান, গত ২৬ জুন আমার স্ত্রী মহিমা আক্তারের প্রসব বেদনা উঠলে পরিচিত কয়েকজনের পরামর্শে নরমাল ডেলিভারীর জন্য কক্সবাজার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে বাচ্চা ডেলিভারী হওয়ার সময় সাইট সিজার করে আমার স্ত্রী প্রস্রাবের রাস্তায় বড় ধরনের অপারেশন হয়েছে সেটা আমাদের জানানো হয়নি। তারপরও আমার কাছ থেকে ঔষধ খরচ ২ হাজার বাদে ভিজিটর রৌশন ফারহানাকে নাস্তা বাবদ ৩হাজার টাকা নেয়া হয়। 
 

 তবে সমস্যা হচ্ছে দেড় মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও আমার স্ত্রী বাসায় চরম ব্যথায় কাতরাচ্ছিলো। ২ দিন পরে আবারো মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে গেলে আমার স্ত্রীকে উল্টো খারাপ ব্যবহার করে। পরে ৩ টি পায়ুপথে ঔষধ দিয়ে ডাক্তার দেখালে তারা বলেছেন এখানে সাইট অপারেশন অনেক বড় হওয়াতে বেশ জটিলতা হয়েছে। 
 

এদিকে গত এক সপ্তাহ ধরে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে পরিদর্শন করে দেখা গেছে হাসপাতালের বর্তমান মেডিকেল অফিসার ডা: সিরাজাম মুনিয়া প্রতিদিন আসেন বেলা ১১ টার দিকে আসে আর চলে যান ৩ টায়। সেবা নিতে আসা রোগিদের দেখছেন সহকারী নার্সি এটেনডেন্ট নীতা চাকমা। এ সময় দেখা গেছে, হাসপাতালে আসা জরুরী বিভাগের রোগিরদের টিকিট দিচ্ছে ফার্মেসীর দায়িত্ব পালনকারী একজন মহিলা। তারাই রোগিদের দেখে ঔষধ লিখে দিচ্ছে। টানা ৩ দিন পর্যবেক্ষণ করেছি কোন রোগিকে দেখা যায়নি ডাক্তার সিরাজাম মুনিরার চেম্বারে ঢুকে চিকিৎসা নিতে। ডাক্তারকে দেখা গেছে ডিউটিকালীন অধিকাংশ সময় ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাতে ব্যস্ত থাকতে।
 

 মিঠাছড়ি থেকে আসা মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার প্রথম বাচ্চা ২০২২ সালে এখানে হয়েছিল। সে জন্য আমি আবার এখানে এসেছি তবে এখন পরিস্থিতি খুবই খারাপ, আমি এসেছি ডাক্তার দেখাতে নার্সরা দেখে বিদায় করে দিচ্ছে। ডাক্তারের কথা বলাতে নার্সরা আমাকে চরম খারাপ ব্যাবহার করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর স্লিপে যে ঔষধ লিখে দিয়েছে তাও নাকি নাই বাইরে থেকে কিনতে হবে।
 

১২ আগই খুরুশকুল থেকে আসা সানজিদা বেগম বলেন, আমরা ডাক্তার দেখাতে এসেছি এখানে ডাক্তারের বদলে রোগি দেখছে প্যারামেডিক এবং ফার্মেসীর দায়িত্বপ্রাপ্তরা এটা কেমন কথা। আর ডাক্তার পাশের রুমে আছে তবে সেখানে ঔষধ কোম্পানীর লোকজন ছাড়া কেউ ঢুকতে পারেনা।
 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজনে বলেন, এখানে দুই জন মেডিকেল অফিসার আছেন তারা সম্পর্কে স্বামী স্ত্রী। তবে মহিলা ডাক্তার হচ্ছে মূল দায়িত্বে উনি ২৪ ঘণ্টা কেন্দ্রে থাকার কথা,কিন্তু তিনি বেলা ১১ টার পরে আসেন ৩ বা ৪ টার দিকে চলে যান। রাতে কোন রোগী আসলে ভিজিটররা যা পারে তাই করেন। তবে ভিজিটরদের বাধ্যতামূলক ভাবে ৩ হাজার টাকার উপরে বকশিস আর ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার উপরে নাস্তা খরচ দিতে হয়। আর ডাক্তারের সরকারি বাসভবনে থাকার নিয়ম থাকলেও তিনি থাকেন বাইরে। তবে আগের চেয়ে সিজারের সংখ্যা বাড়লেও সেক্ষেত্রে গুনতে হয় ১০ হাজার টাকা। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন বলে প্রাইভেট হাসপাতালে রেফার করে দেয়া হয়। তবে শিশু সেবা, গর্ভকালীন সেবা, গর্ভপরবর্তী সেবাগুলো মোটেও নাই বললেই চলে। 
 

এ ব্যাপারে শহরের বাহারছড়ার বাসিন্দা কাস্টমস অফিসার আবছার উদ্দিন বলেন, জেলা সদর হাসপাতালের গাইনী ওয়ার্ডে রোগির চাপে সিট নেই, পার্শ্ববর্তী সব প্রাইভেট হাসপাতালে রোগির চাপে সিট নাই তাহলে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে কেন ফাঁকা থাকে। সেটাকি কর্তৃপক্ষ দেখেনা। কেন এমন হচ্ছে এখানে কি সরকার টাকা দিচ্ছে না,সেই টাকাতো জনগণের টাকা।
 

এ ব্যপারে ডাক্তার মুনিরা বলেন, আগে থেকে প্যারামেডিক বা সহযোগিরা রোগী দেখতো। জটিলতা বা সমস্যা হলে সেই রোগিকে আমার কাছে পাঠায়। আর প্রতি মাসে এখন নিয়মিত ১০/১২ টি সিজার হচ্ছে। যা আগে হতনা। আর সরকারি ভাবে ১ বছর ধরে কোন ঔষধ বরাদ্ধ নাই। আর বাইরে থাকার কারন হচ্ছে সরকারি বাস ভবন মেরামতের কাজ চলছে। আগে এনজিওর বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট ও লোকবল ছিল, এখন নাই তাই একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে সামনের মাস থেকে আবারো কয়েকটি এনজিও কাজ করবে তখন ঠিক হয়ে যাবে।
 

এ ব্যাপারে কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. নুরুচ্ছফা বলেন, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে আগামী মাস থেকে ভাল সেবা পাবে কারন নতুন ভাবে ২ জন মেডিকেল অফিসার নিয়োগ হয়েছে। আর অন্যান্য সংকটও দ্রুত দূর হবে।
 

কক্সবাজার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে বিদ্যমান অনিয়ম, দুর্নীতির চিত্র যেন একটি প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে একদিকে সরকার বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, অন্যদিকে বাস্তবে গর্ভবতী মায়েরা সেবা নিতে এসে হচ্ছেন প্রতারিত, লাঞ্ছিত ও অর্থনৈতিকভাবে শোষিত।
 

এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর ও ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।