করের চাপ বেশি দেওয়া হচ্ছে গরিবের ওপর

প্রকাশকালঃ ০৪ জুন ২০২৩ ০৪:৪৮ অপরাহ্ণ ১৭৩ বার পঠিত
করের চাপ বেশি দেওয়া হচ্ছে গরিবের ওপর

বাজেট আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, অন্য সব দেশে মূল্যস্ফীতি কমছে। প্রতিবেশী ভারতেও তা ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে এখনো ৯ শতাংশের বেশি।

দেশের রাজস্ব সংগ্রহের পদ্ধতিতে বড় ধরনের সমস্যা চলছে। করদাতা ও কর সংগ্রহকারীর মধ্যে অনেক সময় দেনদরবার চলে। এরপর তা নিষ্পত্তি হয়। আর এ অবস্থার মধ্যেই অতীতের সব অভিজ্ঞতা ছাপিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ শতাংশ বেশি।

নতুন বাজেটের ওপর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত আলোচনা সভায় এসব কথা উঠে আসে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বক্তব্য দেন পিআরআইর চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার ও ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ; এমসিসিআইর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কামরান টি রহমান, সহসভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম ও পরিচালক আদিব এইচ খান।


পিআরআইর ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ বলেন, এনবিআর যেন পুলিশি সংস্থা হয়ে যাচ্ছে। মানুষকে হেনস্তা করে এত কর আদায় সম্ভব নয়। দুর্নীতি ও কর ফাঁকি না কমিয়ে গরিবের ওপর কর আদায়ের এত চাপ দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।

গত কয়েক বছরে রাজস্ব সংগ্রহের গড় লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ বাড়ানো হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে তা ৩৭ শতাংশ নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাদিক আহমেদ। তিনি জানান, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের আদায় পরিস্থিতি বলছে যে অর্থবছর শেষে তা বাড়তে পারে বড়জোর ৮–৯ শতাংশ।

সাদিক আহমেদ আরও বলেন, ‘ধনীদের থেকে কম কর আদায় করা হচ্ছে। ধনীদের কাছ থেকে বেশি আদায়ের পরিবর্তে সাধারণ লোকের কাছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা চাওয়া খয়রাতির মতো।’

প্রস্তাবিত বাজেটে চারটি চ্যালেঞ্জ দেখতে পান বলে জানান সাদিক আহমেদ। এগুলো হচ্ছে, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, রাজস্ব সংগ্রহ, বাজেট–ঘাটতি পূরণের অর্থায়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে না পারলে অর্থনীতি বড় ধরনের হুমকিতে পড়তে পারে।


এমসিসিআইর সহসভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, ‘করদাতাদের ‘‘কাস্টমার’’ মনে করে এনবিআর। অথচ যুগ পাল্টেছে। ঔপনিবেশিক মানসিকতার বদল চাই। একশ্রেণির করদাতার ফাঁকির প্রবণতাও বদলাতে হবে।’

পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনার মাধ্যমে এমসিসিআইর পরিচালক আদিব এইচ খান বলেন, কাল রোববার (আজ) বিল আকারে জাতীয় সংসদে উঠবে আয়কর আইন, ২০২৩। এটি পর্যালোচনা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের আরও সময় দেওয়া দরকার।


আদিব এইচ খান আরও বলেন, ভূমি, ভবন ও সম্পত্তি কেনাবেচায় কর ৪ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ অর্থাৎ ৮ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। গাড়ির ওপর কার্বন কর ধরা হয়েছে। কিন্তু এই কর বাস-ট্রাকের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। সফটওয়্যারের ওপর অপ্রত্যাশিতভাবে ৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশি ঋণে সুদের ওপর ১৯৭৬ সাল থেকে যে কর অব্যাহতি ছিল, নতুন বাজেটে তা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব কারণে ব্যবসায়ের খরচ বাড়বে।


মুক্ত আলোচনায় মেট্রো চেম্বারের সাবেক সভাপতি আনিস উদ দৌলা অগ্রিম আয়কর বাদ দেওয়ার জন্য বছরের পর বছর ধরে দাবি করে এলেও তা থেকেই যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন।

সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদদের সংস্থা আইসিএবির সাবেক সভাপতি শাহাদাত হোসেন বলেন, করদাতা ও কর সংগ্রহকারীদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি রয়েছে।


দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি কমছে
পিআরআইর ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ বলেন, তথ্যের পরিবর্তে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবকে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির জন্য দায়ী করা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক। যদিও অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির চাপের উৎস আমদানি করা উৎসের মধ্যে নিহিত থাকে। তবে পর্যাপ্ত চাহিদা ব্যবস্থাপনা নীতি না থাকার কারণেও টিকে থাকে মূল্যস্ফীতি।

কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সত্ত্বেও থাইল্যান্ড, ভারত, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বলে মন্তব্য করেন সাদিক আহমেদ। বলেন, সুদের হার বাড়িয়ে চাহিদা কমানোর নীতি অবলম্বন করে এসব দেশ সফলভাবে মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে।

দেশ ধরে ধরে সাদিক আহমেদ মূল্যস্ফীতির চিত্র এবং কোন দেশ কী হারে কমিয়েছে, তা তুলে ধরেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয় ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। তিনি জানান, ওই বছরের জুনে থাইল্যান্ডে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। কমে গত এপ্রিল মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ২ দশমিক ৭ শতাংশে।


ভারতে ২০২২ সালের এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এ বছরের এপ্রিলে তা কমে হয় ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। গত এপ্রিল মাসে তা দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৯ শতাংশে। ইইউভুক্ত দেশগুলোতে গত বছরের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। গত এপ্রিলে কমে তা দাঁড়ায় ৭ শতাংশে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা আগের বছরের আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বলেন, বাজারব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখতে হবে। তাহলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।

পিআরআইর চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার বলেন, নির্বাচনী বাজেটে বেশি ব্যয় ধরা হলেও এবার তা দেখা যায়নি। মূল্যস্ফীতির হার কমানোর জন্য তিনি শুল্কহার কমানোর পক্ষে।


পরিকল্পনামন্ত্রী আরও যা বললেন
বক্তারা পরোক্ষ করের প্রতি বেশি জোর দিতে বললেও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান পরোক্ষ কর অর্থাৎ ভ্যাটের পক্ষে কথা বলেন। তাঁর যুক্তি হচ্ছে, ‘আপনি ভ্যাট না দিতে চাইলে জিনিসপত্র কিনবেন না। ভ্যাট রাজস্ব আহরণের একটি ভালো পদ্ধতি।’

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হবে। কিন্তু ভর্তুকির ধারণা থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে হবে। দুই হাজার টাকা কর নেওয়ার পদ্ধতি মানুষকে কর দেওয়ার অভ্যাস তৈরিতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন তিনি।

সবার জন্য নয়; বরং কয়েকটি সেবার বিপরীতে দুই হাজার টাকা করের প্রশ্নটি এসেছে জানিয়ে এম এ মান্নান যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সময়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, থ্যাচার একবার দুধের ওপর কর বসিয়েছিলেন। ওই সময় বাচ্চারা রাস্তায় স্লোগান দিত ‘থ্যাচার, থ্যাচার, মিল্ক স্নেচার (ছিনতাইকারী)।’