কোরআনের নবী ও রাসুলের ধৈর্যের পরীক্ষা সম্পর্কে আলোকপাত
প্রকাশকালঃ
২২ জুলাই ২০২৩ ০৫:২৯ অপরাহ্ণ ২২১ বার পঠিত
মানবজীবনে সুখ ও দুঃখ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কোরআনের ভাষ্যমতে মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করা হয়। এমনকি যুগে যুগে মানুষকে সৎপথ প্রদর্শনকারী নবী-রাসুলরাও কঠিন বিপদের মুখোমুখি হয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে তারা ধৈর্যের সুউচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
পবিত্র কোরআনে ধৈর্যধারণকারীর জন্য সুসংবাদ এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাদের সামান্য ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, প্রাণ ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে অবশ্যই পরীক্ষা করব, আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন, যারা বিপদে আক্রান্ত হলে বলে, আমরা তো আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই ফিরব।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৫-১৫৬)
ধৈর্য নবীদের বৈশিষ্ট্য
সব পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করা ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে অবিচল থাকা নবী-রাসুল ও মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিপদে ধৈর্য ধারণ করলে সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
সাআদ বিন আবু ওয়াক্কাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), মানুষের মধ্যে কে সব চেয়ে কঠিন বিপদের মুখোমুখি হয়? তিনি বলেন, প্রথমত নবীরা, অতঃপর যারা তাদের মতো। অতঃপর মানুষকে তার দ্বিনদার অনুপাতে পরীক্ষা করা হয়। কেউ শক্তভাবে দ্বিন অনুসরণ করলে তার পরীক্ষাও কঠিন হয়ে থাকে। কেউ দ্বিনদারিতে শিথিল হলে তার পরীক্ষাও তেমন হয়।
অতঃপর বান্দা একের পর এক বিপদে আক্রান্ত হতে থাকে। একপর্যায়ে সে পুরোপুরি গুনাহমুক্ত হয়ে ভূমিতে চলাফেরা করে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৯৮)
নবীদের ধৈর্যের পরীক্ষা
নিম্নে কঠিন সময়ে কয়েকজন নবী ও রাসুলের ধৈর্যের পরীক্ষা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
১. মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান : প্রায় হাজার বছর ধরে নুহ (আ.) মানুষকে আল্লাহর নির্দেশনা পালনের আহ্বান জানান। কিন্তু খুবই সামান্যসংখ্যক মানুষ তার আহ্বানে সাড়া দেয়।
তবু তিনি নিজ সম্প্রদায়ের ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও নির্যাতনের মধ্যে আল্লাহর পথের আহ্বান অব্যাহত রাখেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তো নুহ (আ.)-কে তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে পাঠিয়েছিলাম, তিনি তাদের মধ্যে ৫০ বছর কম এক হাজার বছর অবস্থান করেন, অতঃপর তাদের প্লাবন গ্রাস করে। কেননা তারা সীমালঙ্ঘনকারী ছিল। অতঃপর আমি তাকে ও যার নৌকাবাসীকে রক্ষা করেছি এবং বিশ্ববাসীর জন্য তাকে নিদর্শন করেছি।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ১৪-১৫)
২. ধৈর্যশীলদের প্রতীক যিনি : আইয়ুব (আ.) নবী ও রাসুলদের মধ্যে ধৈর্যশীল হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত। পবিত্র কোরআনে তাঁর এ গুণের প্রশংসা করা হয়েছে। কারণ দীর্ঘ ১৮ বছর শারীরিক ও আর্থিক নানা সমস্যায় ভুগেও মহান আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ কৃতজ্ঞ ছিলেন তিনি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করুন আমার বান্দা আইয়ুবকে, তিনি তাঁর রবকে ডেকে বলেন, শয়তান আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টে ফেলে দিয়েছে। আপনি পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত করুন, এতে গোসলের সুশীতল পানি ও পানীয় রয়েছে। আমার অনুগ্রহে আমি তাকে তার পরিবার দান করেছি এবং তাদের মতো আরো, তা বুদ্ধিমানদের জন্য উপদেশস্বরূপ। আপনি এক মুষ্ঠি তৃণ নিয়ে আঘাত করুন এবং শপথ ভঙ্গ করবেন না, আমি তাকে ধৈর্যশীল হিসেবে পেয়েছি, কতই না উত্তম ছিলেন তিনি, তিনি ছিলেন আমার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সুরা সাদ, আয়াত : ৪১-৪৪)
৩. যিনি আল্লাহর প্রিয় বন্ধু : শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর একত্ববাদের প্রচারে অবিচল ছিলেন। নিজ পরিবার থেকে শুরু করে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে তিনি তাওহিদের কথা বলে যান। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে আগুনে নিক্ষেপ করে। এত কিছুর পরও তিনি স্থির ছিলেন এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থাবান ছিলেন। ফলে আল্লাহর নির্দেশে সেই জ্বলন্ত আগুন তাঁর জন্য শীতল হয়ে যায়। জীবনের পড়ন্ত বেলায় তিনি হাজেরা (আ.) ও পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে মক্কার জনশূন্য প্রান্তরে রেখে আসেন। এমনকি তার প্রিয় পুত্রকে কোরবানি করতে বলা হয়। এসব পরীক্ষায় তিনি আল্লাহর নির্দেশ পালন করেন এবং খাঁটি বন্ধুর স্বীকৃতি লাভ করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘দ্বিনের ক্ষেত্রে তার চেয়ে আর কে উত্তম যে সৎকর্মশীল হয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং একনিষ্ঠভাবে ইবরাহিমের আদর্শ অনুসরণ করে, আল্লাহ ইবরাহিমকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১২৫)
৪. দীর্ঘ অপেক্ষার পর সন্তানের সন্ধান : ইয়াকুব (আ.) প্রিয় পুত্র ইউসুফ (আ.)-কে হারিয়ে অত্যন্ত ব্যথিত হন। তখন তিনি ধৈর্যকে নিজের একমাত্র সম্বল হিসেবে গ্রহণ করেন এবং আল্লাহর ওপর আস্থা রাখেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা (ইউসুফের ভাইয়েরা) তার জামায় মিথ্যা রক্ত লেপন করে আনে, তিনি (ইয়াকুব আ.) বলেছিলেন, না, তোমরা এই ঘটনা সাজিয়েছ, অতএব পূর্ণ ধৈর্য ধারণ করাই উত্তম, তোমরা যা বলছ এই ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যকারী।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ১৮)
অতঃপর ইয়াকুব (আ.) দ্বিতীয় সন্তানকে হারান। তিনি নিজের সব দুঃখ-ব্যাথাকে আল্লাহর কাছে অর্পণ করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি বললেন, আফসোস ইউসুফের জন্য, শোকে তার দুই চোখ সাদা হয়ে পড়ে, তিনি খুবই কষ্টে ছিলেন।...তিনি বলেন, আমি আমার দুঃখ ও বেদনা আল্লাহর কাছে আবেদন করছি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কিছু জানি, যা তুমি জানো না। হে আমার সন্তানরা, তোমরা যাও, ইউসুফ ও তার ভাইকে অনুসন্ধান কোরো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হইয়ো না। কেননা অবিশ্বাসী ছাড়া কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয় না।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৮৬-৮৭)
৫. মাছের উদোরে আল্লাহকে স্মরণ : ইউনুস (আ.) দীর্ঘ সময় মানুষকে আল্লাহর নির্দেশ পালনের কথা বলেন। কিন্তু অল্প কয়েকজন ছাড়া কেউ তার মানেনি। নিরাশ হয়ে তিনি তাদের ছেড়ে চলে যান। অতঃপর নানা ঘটনার পর তাঁর আশ্রয় হয় একটি মাছ উদরে। সেখানে তিনি ৪০ দিন পর্যন্ত অতবাহিত করেন। এ সময় তিনি শুধু আল্লাহর কাছে অনুনয় করে দোয়া করতেন। ইরশাদ হয়েছে, ইউনুস ছিল রাসুলদের একজন। স্মরণ করুন, তিনি পালিয়ে একটি ভর্তি নৌকায় যান। অতঃপর লটারিতে অংশ পরাজিত হন। তাকে একটি বড় মাছ গিলে ফেলে তখন তিনি নিজেকে তিরস্কার করতে থাকেন। তিনি আল্লাহর তাসবিহ না পড়লে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত মাছের উদরে থাকতেন।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত : ১৩৯-১৪৪)
তাই পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-কে তার কথা উল্লেখ করে তার মতো ধৈর্যহারা হতে বারণ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব আপনি আপনার রবের নির্দেশে ধৈর্য ধারণ করুন, আপনি মাছাওয়ালার মতো হবেন না, যখন তিনি দুঃখে কাতর হয়ে ডেকেছিলেন। তার রবের অনুগ্রহ তার কাছে না পৌঁছলে তিনি লাঞ্ছিত হয়ে উন্মুক্ত প্রান্তরে নিক্ষিপ্ত হতেন।’ (সুরা কলম, আয়াত : ৪৮)