করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ টাকা করার প্রস্তাব

প্রকাশকালঃ ১৫ এপ্রিল ২০২৩ ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ ৩৫৮ বার পঠিত
করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ টাকা করার প্রস্তাব

ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। জীবনযাত্রার ব্যয়, মূল্যস্ফীতি এবং সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ টাকায় উন্নীত করার দাবি করা হয়েছে। বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমা বার্ষিক তিন লাখ টাকা।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরামর্শক সভায় এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে এই দাবি করা হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও রাজধানীর একটি হোটেলে এনবিআর ও এফবিসিসিআই যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

কেন করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো উচিত—এর যুক্তি হিসেবে এফবিসিসিআই বলেছে, একজন করদাতার সাধারণ জীবনযাপনের জন্য বার্ষিক যে পরিমাণ ন্যূনতম অর্থের প্রয়োজন, সেই পরিমাণ অঙ্ক করমুক্ত রাখলে কর ফাঁকির প্রবণতা কমে আসবে এবং কর প্রদানে সক্ষম জনগণ কর দিতে এগিয়ে আসবেন। ব্যক্তিগত করভার কমালে সম্পদ ও মূলধন পাচারের প্রবণতা হ্রাস পাবে এবং সঠিক সময়ে আয় প্রদর্শন উৎসাহিত হবে; যা দেশের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অধিক রাজস্ব আহরণে সহায়ক হবে।


এ ছাড়া আগামী বাজেটে ফ্ল্যাট-প্লট কিনে বিনা প্রশ্নে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ; করপোরেট করের শর্ত শিথিল; চাল-ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্য ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ পর্যায়ে উৎসে কর প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন সুপারিশ জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কর অফিসের হয়রানি কমানোর দাবিও করেছেন তাঁরা।

‘কেউ কষ্ট পাবে না’
ব্যবসায়ীদের দাবিদাওয়া উত্থাপন শেষ হলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আগামী বাজেট নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই বাজেটে কষ্ট পাওয়ার মতো কিছু থাকবে না। তিনি আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি বলতে পারব না—এটা করে দেব, ওটা করে দেব। তবে আমি আপনাদের যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণের চেষ্টা করব। উইন উইন সিচুয়েশন বা সবার জন্য লাভজনক এমন বাজেট করা হবে।’ তিনি বলেন, এই বাজেটে সব দাবি পূরণ না হলেও সামনে আরও বাজেট আছে, সেখানে এসব দাবি পূরণ করার সুযোগ আছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আর বেশি দিন ঋণ নিব না। আমরা এখন ঋণ দিই।’

অর্থমন্ত্রীর মতো এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমও ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেন। তিনি বলেন, ‘আশা করি, আপনাদের খুশি করার মতো বাজেট দিতে পারব।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হলে নানা চ্যালেঞ্জ আসবে। তাই আমাদের শিল্প খাতের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সহায়তা দিয়ে নয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তাই বাজেটে এমন সহায়তা কমে আসতে পারে। যাঁরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের শুল্ক-করের ভার নেওয়া উচিত। আমাদের ডলার-সংকটের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।’

এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আগামী বাজেটকে ঘিরে জনগণের ব্যাপক প্রত্যাশা থাকবে। সামগ্রিক বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে একটি জনমুখী ব্যবসাবান্ধব বাজেট হবে বলে ব্যবসায়ীরা আশা করেন।’

আগামী জুন মাসে চলতি অর্থবছরের বাজেট দেবেন অর্থমন্ত্রী। এবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করে বাড়তি রাজস্ব আদায়সহ কর অব্যাহতি কমিয়ে বাজেটের হিসাব-নিকাশ করতে হবে।


আবারও কালোটাকার প্রস্তাব
দেশের আবাসন খাতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ৫ থেকে ১০ বছরের জন্য বিনা প্রশ্নে ফ্ল্যাট কিনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখা দরকার বলে মনে করে এফবিসিসিআই। ফ্ল্যাট, প্লট, বাণিজ্যিক ভবন ও বিপণিবিতানে বিনিয়োগের জন্য বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা বহাল রাখা প্রয়োজন। আগামী ১০ বছর পর্যন্ত এ সুবিধা রাখা হলে দেশে এ-জাতীয় সম্পদ ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে মনে করে এফবিসিসিআই।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এ সুবিধা বহাল আছে।

এফবিসিসিআই বলছে, বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ‘সেকেন্ড হোম’ গ্রহণের সুযোগ থাকায় দেশের প্রচুর অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এসব দেশে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। এ বাস্তবতায় অপ্রদর্শিত অর্থ দেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলে বিনিয়োগকারীরা করজালের আওতায় চলে আসবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে বলে জানিয়েছে এফবিসিসিআই।

এদিকে সব মিলিয়ে এই পর্যন্ত ২১ বার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি বিদেশে পাচার করা টাকাও দেশে ফেরত আনার বিধান রাখা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে ৪০ বছরই কোনো না কোনোভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ ছিল। তেমন সাড়া মেলেনি। আবার কাউকে শাস্তি দেওয়াও হয়নি। এনবিআরের হিসাবে, এই পর্যন্ত ৪৭ হাজার কোটি টাকার মতো কালোটাকা সাদা হয়েছে।

ব্যবসায়ীদের যত দাবি
গতকালের সভায় করপোরেট করের সুবিধা পাওয়ার জন্য শর্ত শিথিল করার সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন এককভাবে ৫ লাখ টাকা এবং বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকার অধিক সব ধরনের খরচ ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে করার শর্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই শর্ত পূরণ না করলে এখন আড়াই শতাংশ বাড়তি করপোরেট কর আরোপ করা হয়।

চাল-ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্য ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ পর্যায়ে ২ শতাংশ উৎসে কর বসে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করে এই কর প্রত্যাহার করার দাবি জানানো হয়েছে।

সব ধরনের রপ্তানি খাতে সমহারে দশমিক ১ শতাংশ উৎসে কর এবং বার্ষিক আয়কর ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে এফবিসিসিআই। আয়কর খাতে সব মিলিয়ে ১১৯টি বাজেট প্রস্তাব দিয়েছে এফবিসিসিআই। এ ছাড়া নতুন আয়কর আইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য এফবিসিসিআই এবং এনবিআর মিলে একটি যৌথ কমিটি গঠনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।

মূল্য সংযোজন কর (মূসক) খাতে ১৭০টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বর্তমানে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সরবরাহের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হয়। এটি কমিয়ে দশমিক ৫ শতাংশ করা; আমদানি উপকরণের ওপর ৩ শতাংশ আগাম কর ধাপে ধাপে প্রত্যাহার; ভ্যাটের দাবি আপিলে গেলে দাবিকৃত অর্থের ২০ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ করা।

আমদানি পর্যায়ে ২৬৪টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই না করে যেসব খাতকে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সেসব খাতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, প্রদত্ত অব্যাহতির প্রভাব; অব্যাহতির মেয়াদ—এসব বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

যেসব শুল্কের টাকা ব্যবসায়ীরা ফেরত পান, তখন ফেরত পাওয়ার সময় ব্যাংক সুদসহ প্রদানের দাবি জানিয়েছে এফবিসিসিআই। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।


হয়রানির অভিযোগ
অনুষ্ঠানে কয়েকজন ব্যবসায়ী কর কার্যালয়ের হয়রানির অভিযোগ করেন। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ভ্যাটের মেশিন এখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে গেছে। একটি শপিং মলে হয়তো ৫০টি দোকানে ভ্যাটের মেশিন বসানো হয়েছে, বেশি দামের ওই সব দোকানে কেউ যেতে চায় না। ফলে একই শপিং মলে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ভ্যাটের মেশিনে কেন এত কম ভাউচার কাটা হচ্ছে—এসব বলে বেশি ভাউচার কাটার চাপ দেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। বেচাকেনা না হলে কীভাবে বাড়তি ভাউচার কাটব?

বাংলাদেশ অ্যালুমিনিয়াম ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ওবায়দুর রহমান অভিযোগ করেন, কয়েক দিন আগে কোনো কারণ ছাড়াই ভ্যাট কর্মকর্তারা সব কাগজপত্র জব্দ করে নিয়ে গেছেন।

অভিযোগ সম্পর্কে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘এ ধরনের সমস্যা হলে সরাসরি আমাদের কাছে আসবেন।’

ব্যবসায়ীরা যা বলেন
কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষকে করের আওতায় আনার প্রস্তাব করেছেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন। তিনি বলেন, বর্তমান কর প্রশাসন দিয়ে সামর্থ্যবান মানুষকে করের আওতায় আনা যাচ্ছে না।

ঢাকা চেম্বার সভাপতি সামির সাত্তার বলেন, করপোরেট কর আরও আড়াই শতাংশ কমানো উচিত। অন্যদিকে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম রপ্তানি পোশাকে উৎসে কর কমানোর প্রস্তাব করেন।

 ‘সরকারি প্রতিষ্ঠান লোকসানের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে আমাদের করের টাকা দেওয়া হয়—এটা অন্যায্য। এটা বন্ধ করা উচিত।’ এমন মন্তব্য করেন বাংলাদেশ স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মানোয়ার হোসেন।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আলমগীর কবির বলেন, ‘মুনাফা না হলে আয়কর দিব কীভাবে? কিন্তু আমাদের কাছ থেকে লাভ-ক্ষতি নির্বিশেষে অগ্রিম কর কেটে রাখা হয়। এটি চূড়ান্ত দায় যেন না হয়, সেই দাবি করছি।’

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, বিশ্বে যখন সব জিনিসের দাম বেড়েছে, তখন চিংড়ির দাম কমেছে। এতে চিংড়ি খাত সংকোচনের মুখে আছে। এ খাতের সুরক্ষা দিতে নগদ সহায়তা বাড়াতে হবে। অগ্রিম কর প্রত্যাহারের কথা জানান তিনি।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান এ খাতের ভ্যাট দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করার দাবি জানান।

নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবদুল মোমেন মোল্লা বলেন, চীন থেকে কম কর দিয়ে কাপড় এসে বাবুরহাট, গাউছিয়া ও ইসলামপুরে ভরে যাচ্ছে। তাতে দেশীয় শিল্প হুমকির মুখে।

সভায় আরও বক্তব্য দেন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি এম এ মোমেন, গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার সভাপতি আবদুল হক, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ আগরওয়াল, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি শমী কায়সার প্রমুখ।