উপাধিপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকায় তাঁর নাম ছিল। সরকারি গেজেটেও পাওয়া গেল তাঁর পরিচয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—মানুষটি কোথায়, কেমন আছেন, কেউই জানে না! সেই রহস্য ভেদ করতে মাঠে নামলেন ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অধ্যাপক বিমল কান্তি দে। শুরু হলো বীর প্রতীক তারামান বিবিকে খুঁজে বের করার দীর্ঘ অনুসন্ধান।

এই বিস্ময়কর অনুসন্ধানের শেষ পর্ব ও সাফল্যের গল্পটি অধ্যাপক বিমল কান্তি দে’র কন্যা সুপর্ণা দে দুই বছর আগে “বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র” গ্রুপে ছবিসহ শেয়ার করেন। সেখানে তিনি লেখেন—
“প্রয়াত বীর প্রতীক তারামন বিবিকে জনসমক্ষে তুলে আনার পেছনে যে গল্প, সেটি আমার বাবা বিমল কান্তি দে’র মুখে শোনা কথা। তাঁর সাত বছরের একক, নিরলস অনুসন্ধানের শেষ দিনের ঘটনাই এখানে বলা হলো।”
বিমল কান্তি দে’র বর্ণনায় উঠে আসে তাঁর যাত্রার কঠিন বাস্তবতা। বিশাল ব্রহ্মপুত্র যখন আসাম পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন নদীর প্রস্থ এতটাই বিস্তৃত হয় যে, এক চর থেকে আরেক চর পাড়ি দিতে সময় আর কষ্টের শেষ থাকে না। রৌমারী–কুড়িগ্রাম অঞ্চল পেরিয়ে যেতে তাকে একের পর এক নদী ও চর অতিক্রম করতে হয়েছে।
তারামান বিবির গ্রাম শংকর মাধবপুরে পৌঁছাতে রাজীবপুর থেকে তিনটি চর ও দুটি নদী পার হতে হয়। বহুবার চিঠি পাঠানো সত্ত্বেও কোনো সাড়া মেলেনি। তাঁর ছাত্র রবিউলের সহায়তায় জামালপুর, দেওয়ানগঞ্জ, রাজীবপুর, রৌমারীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংগ্রহ করে এলোমেলোভাবে চিঠি পাঠানো হয়। কেবল দু’একটি জবাব এলেও তারামন বিবির পরিচয় মিলছিল না।
তারামান বিবিকে খুঁজে পেতে দেরির অন্যতম বড় কারণ ছিল তাঁর পারিবারিক পরিচয়। গেজেটে তাঁর স্বামীর নাম ছিল ‘মেসের আলী’—যিনি তাঁর প্রথম স্বামী এবং মুক্তিযুদ্ধের পর মারা যান। দ্বিতীয় স্বামী মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে নিখোঁজ হন। তৃতীয় স্বামী আব্দুল মজিদের নাম কেউ গেজেটে জানত না। ফলে খোঁজের কাজ আরও জটিল হয়ে ওঠে।
আরও বড় সত্য—তারামান বিবি সমাজের কুসংস্কারের ভয়ে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় গোপন করতেন। কম বয়সী একটি মুসলিম মেয়ে পুরুষদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিলেন—এই তথ্য প্রকাশ হলে সমাজ তাঁকে অপমান করতে পারত।
২৮ অক্টোবর ১৯৯৫, সকাল দশটা।
অধ্যাপক বিমল কান্তি দে পৌঁছালেন রাজীবপুরের শংকর মাধবপুরের মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান সরকারের বাড়িতে। তারামান বিবি আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষায়।
লম্বা, শীর্ণ, রুগ্ণ চেহারা। মাঝে মাঝে কাশছেন। আশপাশের মানুষজন শহরের লোক দেখতে এসেছে—কিন্তু প্রকৃত ইতিহাসের এই গুপ্তধনকে দেখতে এসেছেন একমাত্র তিনি।
বিমল কান্তি দে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। তাঁর ক্ষীণ কণ্ঠে তারামান বিবি উত্তর দিচ্ছেন, মাঝেমধ্যে হাঁপাচ্ছেন। ঘণ্টাখানেকের সাক্ষাৎকার শেষে তাঁকে পাঠানো হলো বাড়িতে।
কিছুক্ষণ পর অধ্যাপক দে যাত্রা করলেন তারামান বিবির ঘর দেখতে।
দূর-দূরান্ত পেরিয়ে গিয়ে তিনি দেখলেন—
ভাঙা কুঁড়েঘর, চালের টিন নেই অনেক জায়গায়
চালের ওপর লতানো কুমড়ো গাছ
একটি ছোট ৯×৭ হাতের ঘর
ভেতরে বাঁশের মাচা ও খড়ের বিছানা
ক্ষুধা, শীত, রোগ, বন্যা—এই চার শত্রুর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বসবাস
মুক্তিযুদ্ধে অদম্য সাহস দেখানো এই নারী বহু দিন ধরে যক্ষ্মা রোগে ভুগছেন। চিকিৎসার অভাবে থেমে থেমে চেষ্টা করলেও পয়সার অভাব ও সরকারি সুবিধার অভাব তাঁকে কোনো স্থায়ী চিকিৎসা দেয়নি।
এ দৃশ্য দেখে গবেষকের চোখে উঠে আসে অশ্রু।
তারামান বিবির জন্য চিকিৎসা নিশ্চিত করতে অধ্যাপক দে রাজীবপুর হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেন।
সাক্ষাৎকারের অডিও রেকর্ড না হলেও ভাগ্যক্রমে তিনি সবগুলো কথা দ্রুত লিখে রাখতে পেরেছিলেন। ফেরার পথে ওষুধ কেনার সামান্য অর্থও তাঁর হাতে তুলে দেন।
দিনশেষে সানন্দবাড়ীর মুক্তিযোদ্ধা সবুর ফারুকীর বাড়িতে গিয়ে সারাদিনের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে পরের দিনের পরিকল্পনা করেন।
অধ্যাপক বিমল কান্তি দে’র নিরলস সাধনা, সংগ্রাম ও মানবিক দায়িত্ববোধেই বহু বছর লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা বীর প্রতীক তারামান বিবি ফিরে আসেন জনসমক্ষে।
তিনি শুধু একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা নন—তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য প্রতীক, যাঁকে খুঁজে পাওয়া ছিল সত্যিই এক বিস্ময়কর অধ্যায়ের সমাপ্তি।