প্রকাশকালঃ
২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ০৩:৩৭ অপরাহ্ণ ৬০৭ বার পঠিত
আমরা সবাই অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের যুগের অধিবাসী।এযুগের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয় কম্পিউটারনামের এই যন্ত্রটির আধুনিক রূপ কিন্তু একদিনে পায়নি। এর জন্য যুগ যুগ ধরে বিশেষজ্ঞদের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে।এরমধ্যে বারংবার এই যন্ত্রের পরিবর্তনও ঘটেছে। সবশেষে আজকের এই আধুনিক রূপ পেয়েছে এবং এর ব্যবহারও সহজ হয়েছে। কম্পিউটার নামের এই যন্ত্রটি কোথা থেকে এলো এবং কিভাবে এলো তা জানার আগ্রহ নিশ্চয়ই প্রত্যেকেরই রয়েছে, তাছাড়া জানাটাও একান্ত আবশ্যক। কারণ যাকে অহরহ ব্যবহার করবো অথচ তার সম্পর্কে কিছুই জানবো না তা কি হয়? কম্পিউটারের আবিষ্কারের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। কম্পিউটারের পূর্বপুরুষ হিসেবে পরিচিত হলো অ্যাবাকাস। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে চীনে আবিষ্কৃত এই যন্ত্রটিতে গুটি সাজিয়ে গণনা করা হতো। অ্যাবাকাস থেকেই পরবর্তীকালে ক্যালকুলেটর, ডিফারেন্স ইঞ্জিন, অ্যানালাইটিক্যাল ইঞ্জিন, ইনিঅ্যাক, আইবিএম ১, জেনিভা, আইবিএম ৭০১, এমআইটি টেলিটাইপ, ইউনিভাক ১, আইবিএম ৩৬০, পিসি ইত্যাদি কম্পিউটারের উদ্ভাবন হয়। কম্পিউটার যন্ত্রের জন্মলগ্ন থেকে এই সময়কাল পর্যন্ত সময়কে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।যেমনঃ(১) প্রাচীন যুগ, (২) মধ্য যুগ এবং (৩) বর্তমান বা আধুনিক যুগ।
(১) প্রাচীন যুগঃ
কম্পিউটারের জন্ম কিন্তু আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় তিন হাজার বছর আগে চীন দেশে গণনা কাজের জন্য এক ধরণের যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। যার নাম ছিল এ্যাবাকাস(Abacus)। এই এ্যাবাকাস (Abacus) নামের যন্ত্রের সাহায্যে প্রাচীন যুগে বিভিন্ন গণনার কাজ করা হতো। আবার এই Abacus থেকেই আধুনিক ক্যালকুলেটর তৈরীর ধারণা এসেছে এটা অনস্বীকার্য।এই যন্ত্রে গণনার কাজের জন্য ব্যবহার করা হতো কতকগুলো গোল চাকতি। এই চাকতি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গণনার কাজ সম্পন্ন করা হতো।কম্পিউটারকে যদি বড় আকারের গণনা যন্ত্র হিসেবে ধরা হয় তাহলে এই এ্যাবাকাস (Abacus)-ই কম্পিউটারের প্রথম চিন্তার সূত্রপাত।
(২) মধ্যযূগঃ
এ্যাবাকাস (Abacus) আবিষ্কারের পর পার হয়ে যায় কয়েক হাজার বছর। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের চিন্তা চেতনা, জ্ঞান ও জানার ক্ষেত্রও হয়ে উঠে বড়ো ও উন্নত। এ্যাবাকাস (Abacus) তৈরী হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় তিন হাজার বছর আগে চীন দেশে। আর প্রথম যান্ত্রিক গণনা যন্ত্র তৈরি হয় ১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে। স্যার ব্লায়াস প্যাসকেল নামের একজন ফরাসি বিজ্ঞানী এটা তৈরি করেন। বিজ্ঞানীর নাসানুসারে এই যন্ত্রের নাম দেওয়া হয়েছিল প্যাসকেলাইন। এটার কার্যপ্রণালী কিন্তু ছিল এ্যাবাকাস (Abacus) এর মতই। তবে এতে চাকতির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছিল দাঁতযুক্ত চাকা বা গিয়ার। প্যাসকেলাইন শুধুমাত্র যোগের কাজ করতে পারতো। মানুষ প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ব্যবহার করলো এই যন্ত্র।
প্যাসকেলাইনের পর ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জার্মান গণিতবিদ গটফ্রিড উইলহেম লিবনিজ নামের একজন বিজ্ঞানী একটি গণনা যন্ত্র তৈরি করেন। এই যন্ত্রের নাম ছিল স্টেফান রেকোনার। এই যন্ত্রে যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ করার কাজ করা যেত। স্টেফান প্যাসকেলাইনের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত ছিল। পেরিয়ে গেল প্রায় আরও সোয়া এক’শ বছর। ১৮২০ সালের মাঝামাঝি স্টেপড রেকোনার যন্ত্রকে আরও একটু উন্নত করলেন টমাস দ্যা কোমার। ততদিনে মানুষও বেশ আধুনিক হয়েছে।নতুন নতুন প্রযুক্তির দিকে তাদের অনুসন্ধান অব্যহত রয়েছে। আর এরই ফলশ্রুতিতে ১৮২১ সালে ঘটে গেল এক বিপ্লব।
চার্লস ব্যাবেজ নামের একজন ইংরেজ গণিতবিদ অংকের বিভিন্ন তথ্যের সহজ সমাধানের জন্য তৈরি করে ফেললেন একটি যন্ত্র। যার নাম দেওয়া হলো ডিফারেন্স ইঞ্জিন।অনতিকাল পরে এই যন্ত্রটিকে আরও আধুনিক করা হলো, নাম দেওয়া হলো এনালাইটিক্যাল ইঞ্জিন। ১৮২১ সালের পূর্বে যেসব যন্ত্র তৈরি হয়েছিল সেগুলো শুধু অংক আর সংখ্যা নিয়ে কাজ করা হতো কিন্তু চার্লস ব্যাবেজের উদ্ভাবিত এই যন্ত্রে অংকের পাশাপাশি তথ্য নিয়েও কাজ করা যেত। তবে এই যন্ত্রের কিছু বাধ্যবাধকতাও ছিল।যন্ত্রটি চালাতে হতো একধরণের ছিদ্রযুক্ত পাঞ্চকার্ড দিয়ে এবং এই পাঞ্চকার্ডটি একবারই মাত্র ব্যবহার করা যেত। দ্বিতীয়বার ব্যবহার করতে হলে আবার নতুন কার্ড প্রয়োজন হতো। ব্যাভেজের যন্ত্রে ছিল তিনটি অংশ। সেগুলো হলো-
(ক)তথ্য বা নির্দেশ প্রদাণের অংশ- এই অংশে থাকবে যন্ত্রটি চালানোর সমস্ত তথ্য বা নির্দেশ এবং বিভিন্ন পর্যায়ের ফলাফল।
(খ)ফলাফল প্রদানের অংশ- এই অংশে গণনার উপযুক্ত ফলাফল প্রদান করবে।
(গ)তথ্য সংরক্ষণ-এই অংশে তথ্যগুলো সংরক্ষণ করা যাবে।
বর্তমানের আধুনিক একটি কম্পিউটারে যেসব অংশ দেখা যায় বা বিদ্যমান রয়েছে চার্লস ব্যাবেজের এনালাইটিক্যাল ইঞ্জিনে তার সবগুলোই বিদ্যমান ছিল। তাছাড়া এই প্রথম কোন যন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে গণনা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ করতে পারতো। সুতরাং এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, চার্লস ব্যাবেজই হচ্ছেন কম্পিউটারের আদি পিতা।
১৮৯০সাল। ডঃ হারম্যান হলোরিথ নামের একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারী বিভাগে কাজ করতেন। সেই সময় লোক গণনার কাজ হাতে নেন আমেরিকান সেনসাস ব্যুরো নামের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান।তারা নিশ্চিত জানতো এই গণনার কাজে লোকবল লাগবে প্রচুর, তেমনি সময়ও লাগবে অনেক। মোটামুটি দশ বছরের আগে গণনার কাজ শেষ করা যাবে না, এমই ধারণা ছিল তাদের।
History of Computers Hollerith’s Tabulating Machine used for the Census ডঃ হারম্যান তাদের এই ধারণা ভেঙ্গে দিলেন। তিনি চার্লস ব্যাবেজের যন্ত্রের সাথে টেবুলেটর নামের একটি যন্ত্র জুড়ে দিলেন। আর এই যন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হলো এতে কাগজের তৈরী পাঞ্চকার্ড ব্যবহার করা যাবে, আর এই পাঞ্চকার্ডে ছিদ্রও করতে পারবে তার এই নতুন যন্ত্র টেবুলেটর। এসময় যন্ত্রটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
এই যন্ত্রের অবিষ্কারের সাথে সাথে পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাড়া পড়ে গেল। অবিশ্বাস্যভাবে ডঃ হারম্যান এই যন্ত্রের সাহায্যে আদমশুমারীর দশ বছরের কাজ শেষ করে ফেললেন মাত্র তিন বছরে। এই অভূতপূর্ব সাফল্য ডঃ হারম্যানকে উদ্বুদ্ধ করে তুললো।তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠা করলেন একটি কোম্পানী। নাম দিলেন টেবুলেটিং মেশিন কোম্পানী। এই কোম্পানীই পরবর্তীতে আইবিএম নামে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কম্পিউটার কোম্পানী হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
(৩) আধুনিক যুগঃ
ডঃ হারম্যানের টেবুলেটর যন্ত্র আবিষ্কারের পর কেটে গেল আরও প্রায় পঞ্চাশ বছর। এই দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটারে ছোটখাটো পরিবর্তন ছাড়া আর তেমন উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি । ১৯৪৩ সালের শুরুর দিকে পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির জন মশলি ও প্রেসপার একার্ট নামের দুই প্রতিভাবান ইঞ্জিনিয়ার প্রথম প্রজন্মের ডিজিটাল কম্পিউটার তৈরিতে হাত দিলেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯৪৬ সালের মাঝামাঝি তারা তৈরি করে ফেললেন প্রথম ইলেক্ট্রনিকস ডিজিটাল কম্পিউটার। তার নাম দেওয়া হলো এনিয়াক।
মার্কওয়ানঃ
পৃথিবীর সভ্যতায় আধুনিকতার ছোঁয়ায় ১৯৪৬ সালের শেষ দিকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার হাওয়ার্ড এইকিন নামের একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী তৈরী করে ফেললেন এনিয়াকের চেয়ে কিছুটা ছোট এবং অরেকটু ক্ষমতাসম্পন্ন ইলেক্ট্রনিকস কম্পিউটার। যার নাম দেওয়া হলো মার্কওয়ান।
ট্রানজিষ্টারঃ
১৯৪৮ সালের শেষদিকে বারডিন, ব্রাটান এবং শকলি নামের তিন প্রতিভাবান আমেরিকান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করলেন ট্রানজিষ্টার। ফলে কম্পিউটার দিগন্তে সূচিত হলো এক নতুন বিপ্লবের। বাল্ব নির্ভর এনিয়াক এবং মার্কওয়ান কম্পিউটারের জায়গা জুড়ে নিল এই ট্রানজিষ্টার লাগানো কম্পিউটার। এই সময়কার কম্পিউটারের মধ্যে ১৯৪৯ সালের তৈরি এডস্যাকের নাম উল্লেখযোগ্য।
ইউনিভ্যাক ওয়ানঃ
১৯৫১ সালে আমেরিকার রেমিংটন র্যান্ড নামের এক কোম্পানী তৈরি করে ইউনিভ্যাক ওয়ান নামের একটি কম্পিউটার। বাণিজ্যিক ডাটা প্রসেসিং কাজের উপযোগী এই কম্পিউটারটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
সিলিকন চিপঃ
স্যার জ্যাক কিলবি ১৯৫৮ সালের মাধ্যমিক পর্যায় এসে আবিষ্কার করেন সিলিকন চিপ। আর সিলিকন চিপের ছোট্ট একটি টুকরোতে স্থাপন করা হয় অনেকগুলো ট্রানজিষ্টর। এই সকল ট্রানজিষ্টর এর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে তৈরি করা হয় অতি সুরু পথ, যাকে বলা হয় সার্কিট। আর এই সার্কিট সংযোজন এর কাজে নাম দেওয়া হলো ইনটিগ্রেটর সার্কিট বা আইসি। আর আইসি বা ইন্টিগ্রেটর সার্কিট দ্বারা কম্পিউটার প্রস্তুতে উৎসাহী হলেন প্রস্তুতকারগণ। পরে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটের অনেক উন্নতি হয়। ছোট্ট একটুকরো সিলিকন চিপের উপর ১৯৭১ সালের দিকে অনেকগুলো আইসি বসানো সম্ভব হয়। আর সন্নিবেশিত এ চিপের নাম দেওয়া হলো মাইক্রোপ্রসেসর। বর্তমান সময়ের আধুনিক কম্পিউটার এই মাইক্রোপসেসরের উপর অনেকাংশেে নির্ভরশীল।
ল্যাপটপ কম্পিউটারঃ
তারপর থেকে উদ্যমী মানুষ একের পর এক উন্নতির সোপানে পা রাখতে শুরু করে। একসময় যে কম্পিউটারকে রাখতে হতো বিশাল হলরুমের আকারের বড় একটি ঘরে। আর এখন একটি কম্পিউটারকে সহজেই একটি ছোট্ট টেবিলেই রাখা সম্ভব হচ্ছে। শুধু মাত্র কি তাই ? এই কম্পিউটারকে আমরা সাথে নিয়ে যে কোন স্থানে স্থানান্তর করে আমাদের জরুরী সকল কাজ করতে পারি। এই কম্পিউটারটি এখন ল্যাপটপ কম্পিউটার নামে সকলের কাছে জনপ্রিয় । এটা ছাড়াও আছে হাতের উপর রেখে কাজ করার মতো কম্পিউটার নাম যার পামটপ কম্পিউটার ইত্যাদি। কম্পিউটারের এই ব্যপক পরিবর্তনের সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র সিলিকন চিপস আবিষ্কারের পর থেকে এর ব্যবহারের মাধ্যমে। এভাবেই আমাদের ব্যবহৃত কম্পিউটার নামের যন্ত্রটির আধুনিকায়ন হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হয়তো আরও অনেক কিছুই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।