হজ কিংবা ওমরাহর ইহরাম পরিধানের পর অনেককে সেলফি বা ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করতে দেখা যায়। এটা খুবই দৃষ্টিকটু ও নিন্দনীয়। আল্লাহর সন্তুষ্টিপূর্ণ হজ ইবাদতের প্রতি যেন ভয়, ভালোবাসা ও আবেগ বলতে কিছুই নেই। অথচ ইহরাম বাঁধার মধ্য দিয়ে হজ ও ওমরাহর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
আর হজ ও ওমরাহ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি যখন হজ বা ওমরাহ কিংবা উভয়টি পালনের উদ্দেশ্যে নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করে, তখন তার ওপর কিছু হালাল ও জায়েজ বস্তুও হারাম হয়ে যায়। এ কারণেই এ প্রক্রিয়াটিকে ইহরাম বলা হয়। আর ইহরাম বাঁধতে হয় ঈমান ও বিশ্বাসের পূর্ণ হৃদয়ের অনুভূতি নিয়ে। কারণ ইহরাম পরিধান হজের প্রাথমিক এমন বিধান, যার মাধ্যমে মহান প্রভুর প্রতি বান্দার গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
প্রাথমিক এই ধাপে যত বেশি ভয় ও ভালোবাসা থাকবে পরবর্তী ধাপগুলো অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারবে। তাইতো আমাদের সালাফরা তথা পূর্ববর্তী মনীষীরা যখন হজের ইহরাম বাঁধতেন আল্লাহর ভয়ে কখনো কখনো বেহুঁশ হয়ে যেতেন। বর্ণিত আছে, একবার আলি ইবনুল হুসাইন (রহ.) ইহরামের কাপড় পরে বাহনে উঠে বসলেন। তখন ভয়ে তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি কাঁপছিলেন। ভয়ের আতিশয্যে তালবিয়া পর্যন্ত পড়তে পারছিলেন না। জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার কী হলো?
তিনি বলেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে, আমি লাব্বাইক বললাম অর্থাৎ হে আল্লাহ, আমি আপনার দরবারে হাজির হয়েছি আর এর উত্তরে বলা হলো, লা লাব্বাইক ওয়া লা সাদাইক অর্থাৎ তুমি হাজির নও এবং তুমি সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্তও নও।’ এ কথা বলে তিনি কিছুক্ষণ পর আবার তালবিয়া পাঠের চেষ্টা করলেন। কিন্তু এবার উট থেকে পড়ে বেহুঁশ হয়ে গেলেন। শরীরে প্রচণ্ড আঘাতও পেলেন। আর পুরো হজে তাঁর মধ্যে এই ভয় কাজ করেছে। (তারিখে দিমাশক : ৪১/৩৭৮)
মালিক বিন দিনার (রহ.)-এর ঘটনা। তিনি একবার ইহরামের কাপড় পরে তালবিয়া পড়তে চাইলেন। কিন্তু ভয়ে তিনি উট থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে আবারও তালবিয়া পড়তে চাইলেন। এবারও পড়ে জ্ঞান হারালেন। বলা হলো, কী হলো আপনার? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে, আমি লাব্বাইক বললাম, আর এর উত্তরে বলা হলো, লা সাদাইক তথা তুমি ভাগ্যবান নও।’ (তারিখে দিমাশক : ৫৬/৪১২)
কাজি শুরাইহ (রহ.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি যখন ইহরাম বাঁধতেন তখন এত চুপচাপ, চিন্তামগ্ন ও আল্লাহমুখী থাকতেন যে তাঁকে বধির সাপের মতো মনে হতো, যেন আশপাশের কোনো কিছু শুনতে পান না। (আততবাকাতুল কুবরা, ইবনে সাদ : ৬/১৯০)
তা ছাড়া ইহরাম পরিধানের পর থেকে বান্দা সব ছেড়ে শুধু আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকবে। এতে ইহরাম পরিধান ও হজের তৃপ্তি অনুভব করবে। সালাফদের হজের জীবনীতে এমনটিই পাওয়া যায়। যেমন—হজরত মাসরুক (রহ.) হজের দিনগুলোতে ঘুমাতেন না; বরং সিজদারত অবস্থায় রাত-দিন কাটানোর চেষ্টা করতেন। অর্থাৎ সারা রাত ইবাদতে কাটিয়ে দিতেন; কখনো সিজদায় গিয়ে ঘুম এসে যেত। ওইটুকুই ছিল তার ঘুম (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৭/১৪৭)
জামরা ইবনে রবিআ ইমাম আওজায়ি (রহ.) সম্পর্কে বলেন, আমি ইমাম আওজায়ি (রহ.)-এর সঙ্গে হজ করেছি। দিনে বা রাতে কখনোই তাঁকে ঘুমাতে দেখা যায়নি। সারাক্ষণ তিনি নামাজ পড়তেন। (তারিখে দিমাশক : ৩৫/১৯৫)
আর মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক আব্দুর রহমান ইবনুল আসওয়াদ সম্পর্কে বলেন, আব্দুর রহমান ইবনুল আসওয়াদ হজের সফরে আমাদের কাছে এলেন। তাঁর একটি পায়ে অসুখ ছিল। এতৎসত্ত্বেও তিনি এক পায়ে ভর করে ফজর পর্যন্ত নামাজ পড়লেন এবং এশার অজু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করলেন। (তারিখে দিমাশক : ৩৪/২৩১)
এই ঘটনাগুলো থেকে হজের সফরে ইবাদতের প্রতি মনোযোগী ও প্রভুপ্রেমের গভীর শিক্ষা পাওয়া যায়। তবে এ ক্ষেত্রে শারীরিক সুস্থতার প্রতিও লক্ষ রাখা জরুরি। কারণ হজের সফরে বেশ কিছু শারীরিক আমল রয়েছে, যা বিশ্রাম ছাড়া অনেকের জন্য কষ্টসাধ্য। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর ভয় ও ভালোবাসা নিয়ে ইহরাম পরিধানের তাওফিক দান করুন।