দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে সংরক্ষিত রয়েছে পবিত্র কোরআনের একটি পুরনো কপি

প্রকাশকালঃ ২৭ আগu ২০২৩ ০১:৫৫ অপরাহ্ণ ২৬৪ বার পঠিত
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে সংরক্ষিত রয়েছে পবিত্র কোরআনের একটি পুরনো কপি

ক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে সংরক্ষিত রয়েছে পবিত্র কোরআনের একটি পুরনো কপি। ইন্দোনেশিয়ার এক ইমামের লেখা কপিটি প্রায় দুই শ বছর আগে ডাচ উপনিবেশিকরা তা নিয়ে আসে। বর্তমানে তা ঐতিহাসিক বো কাপ জেলার আউয়াল মসজিদে রয়েছে। পুরনো কপি নিয়ে বেশ গর্ববোধ করেন স্থানীয় মুসলিমরা। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে মসজিদটি সংস্কারের সময় একটি কাগজের ব্যাগে তা পাওয়া যায়।

গবেষকদের মতে, ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে কাজি আবদুস সালাম স্মৃতি থেকে কোরআনের কপিটি লিখেছেন। ১৭৮০ সালে তুয়ান গুরু নামে পরিচিত এ শিক্ষককে ইন্দোনেশিয়ার তিডোর দ্বীপ থেকে রাজনৈতিক বন্দি করে শাস্তি হিসেবে কেপটাউনে পাঠানো হয়। কারণ তিনি ডাচ উপনিবেশকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।

মসজিদ কমিটির সদস্য কাসিম আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘ধুলোময় একটি ব্যাগে কোরআনের কপিটি পাওয়া যায়। তা দেখে মনে হচ্ছিল, এক শ বছরের বেশি সময় ধরে কেউ এই বাক্সটি ধরেনি। তা ছাড়া তুয়ান গুরুর লেখা ধর্মীয় গ্রন্থের আরো একটি বাক্সও খুঁজে পাওয়া যায়।’ প্রথমদিকের কয়েকটি পৃষ্ঠা কিছুটা ছিন্নভিন্ন থাকলেও পুরো কপিটি প্রায় অক্ষত অবস্থায় ছিল।


লাল ও কালো রঙে আরবি ক্যালিগ্রাফিতে তা লেখা হয়। বিস্ময়করভাবে রংগুলো খুবই ভালো অবস্থায় রয়েছে। ১৬৯৪ সালে লেখা কোরআনের কপিটি মুসলিমদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অনন্য নিদর্শন। কোরআনের ছয় হাজারের বেশি আয়াতের সঠিক ক্রমধারা নিশ্চিত করা এবং তা সংরক্ষণ করা স্থানীয়দের জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জিং ছিল।

পরবর্তী সময়ে কেপটাউনের মুসলিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রধান মাওলানা তোহা কারানের নেতৃত্বে একদল কোরআন বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে কাজটি সম্পন্ন হয়। যাচাই-বাছাই, নিরীক্ষণ ও পৃষ্ঠা বাঁধাইয়ের কাজে সময় লেগেছিল তিন বছর।


আউয়াল মসজিদ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম মসজিদ। ১৭৯৪ সালে তুয়ান গুরু তা প্রতিষ্ঠা করেন। এ মসজিদেই কোরআনের কপিটি সবার প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়। অবশ্য ১০ বছর আগে মূল্যবান নিদর্শনটি তিনবার চুরির ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। পরবর্তী সময়ে কর্তৃপক্ষ মসজিদের সামনে ফায়ার ও বুলেট প্রুফ কেসিংয়ে তা সংরক্ষণ শুরু করেন।

জীবনীকার শফিক মর্টনের দৃঢ় বিশ্বাস, রবেন দ্বীপে বন্দি থাকাকালে তুয়ান গুরু কোরআনের কপিটি লেখা শুরু করেন, যেখানে নেলসন ম্যান্ডেলাও ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বন্দি ছিলেন। একই সময় তিনি আরো পাঁচটি গ্রন্থের অনুলিপিও রচনা করেন। সেখান থেকে মুক্তির পরও তিনি লেখার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছিলেন। বেশির ভাগই তাঁর ৮০ থেকে ৯০ বছর বয়সের মধ্যে লেখা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আরবি ভাষী না হয়েও এসব গ্রন্থ রচনার ফলে বিশেষজ্ঞ মহলে তাঁর বইয়ের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মূলত তুয়ানকে ৬৯ বছর বয়সে ১৭৮০-১৭৮১ সাল পর্যন্ত একবার এবং ১৭৮৬-১৭৯১ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয়বার রবেন দ্বীপের জেলে পাঠানো হয়েছিল।


শফিক মর্টন আরো জানান, তিনি যখন কোরআন লিখছিলেন তখন তাঁর চারপাশে অনেক দাস অবস্থান করছিল। তিনি উপলব্ধি করেন, তিনি কোরআনের একটি কপি লিখতে পারলে তিনি এসব লোককে তা শিক্ষা দিতে পারবেন। পাশাপাশি তিনি তাদের মানুষের সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে শেখাতে পারবেন। তাই আর্কাইভে থাকা ডাচদের ব্যবহৃত কাগজের সঙ্গে তুয়ান গুরুর কাগজের মিল রয়েছে। সম্ভবত তা একই কাগজ ছিল। তুয়ান গুরু নিজেই নিজের কলম বাঁশ থেকে তৈরি করতেন। আর ঔপনিবেশিকদের কাছ থেকে কালি সংগ্রহ করা খুবই সহজ ছিল।

দক্ষিণ আফ্রিকার ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক শিক্ষক শায়খ ওয়াইসি কেপটাউনে হাতে লেখা কোরআন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। তাঁর মতে, তুয়ান গুরু মুসলিম বন্দি ও দাসদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম সংরক্ষণের চেষ্টা চালান। একই সময় ডাচ উপনিবেশ কর্তৃক তাদের মধ্যে বাইবেল প্রচার করা হতো এবং মুসলিমদের ধর্মান্তরের চেষ্টা করা হতো। তাই তুয়ান গুরু কোরআনের কপি লিখে বাচ্চাদের শেখাতেন এবং তাদের মুখস্থ করতে বলতেন। মূলত এর মাধ্যমে অধ্যবসায়ের দিকটি সুস্পষ্ট হয়। কেপটাউনে দাস ও বন্দি হিসেবে নিয়ে আসা মানুষের শিক্ষার চিত্রও আমরা দেখতে পাই। 

তিনি এখানে এসে ইসলাম ধর্মের করুণ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। তাই মুসলিমদের সামাজিক অবস্থান উন্নতিতে তিনি বহুমুখী ভূমিকা পালন করেন। আসলে তাদের পড়ার মতো তেমন কিছুই ছিল না। বরং তারা অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে সাংস্কৃতিক দিক দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম ছিলেন। মুসলিম সমাজের বর্তমান সম্মানজনক অবস্থান তৈরিতে গুরুর লিখিত কোরআনের প্রথম কপিটির ব্যাপক অবদান রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় তুয়ান গুরুর নির্বাসন এই অঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। বর্তমানে কেপটাউনে আনুমানিক ৪৬ লাখ মুসলিম বসবাস করেন যা মোটজনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ।