উপমহাদেশের আলেমদের মুসলিম জাগরণে অবদান

প্রকাশকালঃ ২৩ জুলাই ২০২৩ ০৬:১৪ অপরাহ্ণ ২১৭ বার পঠিত
উপমহাদেশের আলেমদের মুসলিম জাগরণে অবদান

মুসলিম জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে তারা কখনো এমন বিপর্যয়ের শিকার হয়নি যার পরে তাদের উত্থান হয়নি, তারা কখনো এমনভাবে ঘুমিয়ে পড়েনি যার পরে তারা জাগ্রত হয়নি। তবে বর্তমান বিপর্যয়টি ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ বিপর্যয়। বর্তমানে মুসলিম জাতি চতুর্মুখী হামলার শিকার এবং তারা বিভিন্ন প্রশ্নে বিভক্ত। এই সংকটের সমাধান করা সমাজসংস্কারক আলেমদের জন্য কঠিন।

তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে মুসলিম জাতি আল্লাহর মনোনীত শেষ জাতি। সুতরাং আল্লাহ পৃথিবীর বুকে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবেন এবং চূড়ান্ত বিজয় তাদের জন্য নির্ধারিত। তবে এ জন্য তাদের সেসব উপায়-উপকরণ ও মাধ্যম সম্পর্কে অবগত হতে হবে, যা তাদের পুনর্জাগরণ ও উন্নয়নের পথে অগ্রযাত্রার নিশ্চয়তা দেবে। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর জাগরণের পথ ও পদ্ধতি সাধারণ মুসলমানের অনুসৃত পথ-পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

সেটা ঠিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত হবে না, যদিও এসব কাজ নিজ নিজ জায়গায় যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।

মুসলিম জাতির পুনর্জাগরণের সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি কোরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। এটাই মুসলিম জাতির শক্তি-সামর্থ্যের মূল উৎস। মুসলিম জাতির জাগরণে সবচেয়ে প্রভাবক শক্তি পবিত্র কোরআন।


কোরআনের চর্চা ও তিলাওয়াত এ জাতির জন্য অপরিহার্য। সব যুগের মুসলমানের জন্য কোরআনের জ্ঞান অর্জন করা মৌলিক দায়িত্ব। এরপর মুমিনের দায়িত্ব মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসায় অন্তর ভরপুর থাকবে। পরিস্থিতি যত নাজুক ও ভয়াবহ হোক না কেন মুসলমান যদি কোরআনের শিক্ষা ও নবীজি (সা.)-এর আদর্শ-ভালোবাসা বুকে ধারণ করতে পারে, তবে তারা উত্তরণের আশা করতে পারে। এই দুই শক্তিই তাদেরকে মানবজীবনের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করতে পারে এবং তাদেরকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

যদিও তারা বারবার পতনের মুখে পড়ে। মুসলিম জাতিকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করা এবং তাদের উত্তরণের পথে নিয়ে যাওয়ার কাজ সবার মাধ্যমে হয় না, এ কাজ তাদের মাধ্যমেই হয় যাদের আল্লাহ যুগ সংস্কারক হিসেবে মনোনীত করেছেন এবং এ জাতির অভিভাবক হিসেবে প্রস্তুত করেছেন। তারা তাদের জীবনের সর্বস্ব দিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেন। যেন মুসলিম উম্মাহ সংকট কাটিয়ে নিজের অবস্থানে ফিরতে পারে।

খুশির সংবাদ হলো, দীর্ঘ আলস্য ও উদাসীনতার পর মুসলিম উম্মাহর ভেতর নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম জাতির ভেতর রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। আরববিশ্বে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক জাগরণ সৃষ্টি হয়। এ জাগরণে সাইয়েদ জামাল উদ্দিন আফগানি ও শায়খ মুহাম্মদ আবদুহু (রহ.)-এর অবদান স্মরণীয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জাগরণে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহ.)-এর শিষ্য ও পরিবারের সন্তানরা কৃতিত্বের দাবিদার। যেমন সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.), শাহ ইসমাইল শহীদ (রহ.) প্রমুখ। সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাদের চেষ্টা, শ্রম ও আত্মত্যাগও বিশেষভাবে স্মরণীয়। ভারতীয় মহাদেশে জ্ঞানগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব তৈরির প্রচেষ্টাও মুসলিম জাগরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে। ভারতীয় উপমহাদেশে জ্ঞানগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের পুরোধা ছিলেন শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি (রহ.) ও মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর (রহ.)। পরবর্তী সময়ে এমন আরো বহু ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়, যাঁরা পূর্বসূরিদের আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে কাজ করে গেছেন। যদিও তাঁদের কেউ কেউ খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন।


অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশগুলোর সৌভাগ্য যে সেখানে জামাল উদ্দিন আফগানি (রহ.)-এর মতো একাধিক ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছেন, যাঁরা সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন এবং দ্বিনের প্রচার-প্রসারে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। শায়খ হাসানুল বান্না শহীদ (রহ.) তাঁদের মধ্যে অগ্রগামী। তিনি মুসলিম যুবকদের ভেতর আত্মমর্যাদাবোধ ও সাহসিকতার প্রাণ সৃষ্টি করেছেন, জাতির উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার জন্য তাদের ভেতর ঈমানি চেতনা, স্পৃহা ও আবেগ ঢেলে দিয়েছেন। তাঁর সহকর্মী ও শিষ্যদের ত্যাগ ও বিসর্জন মুসলিম বিশ্বের ইসলামী জাগরণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। মুসলিম জাগরণে ভারতীয় উপমহাদেশের আলেমরাও সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁদের শ্রম, ত্যাগ ও প্রচেষ্টা মুসলমানের বৈশ্বিক জাগরণকে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করেছিল। ভারতীয় আলেমদের দ্বিনি সংগ্রামকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায় : ১. ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার আন্দোলন, ২. ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, ৩. ইসলামী শিক্ষা ও দীক্ষার প্রসারের প্রচেষ্টা।

মুসলিম বিশ্বে ভারতীয় উপমহাদেশের একটি বিশেষ গুরুত্ব থাকার কারণ হলো পৃথিবীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলমান ভারতবর্ষে বসবাস করে। এখানে ইসলামী কর্মকাণ্ড, ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও প্রচারমাধ্যমও তুলনামূলক বেশি। এ ছাড়া ইসলামী জাগরণের সূচনা এখান থেকে হয় এবং ধীরে ধীরে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ে।

ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম জাগরণে ভারতীয় মুসলমানের খেলাফত আন্দোলন জোরালো রসদ জুগিয়েছিল। এই আন্দোলন মুসলিম জাতির আত্মমর্যাদা, সাহসিকতা ও মনোবল বৃদ্ধি করেছিল। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে দানা বাঁধা খেলাফত আন্দোলনের সংযোগ ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে এবং এর প্রভাব পড়েছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বে। খেলাফত আন্দোলন মুসলমানের আত্মমর্যাদাবোধ ও সাহসিকতাই শুধু তৈরি করেনি, বরং ভিনদেশি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সমাজ, বর্ণ ও শ্রেণিতে বিভক্ত ভারতীয় সমাজকে একতাবদ্ধ করেছিল, তাদের সহযাত্রী ও সহযোদ্ধায় পরিণত করেছিল। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগ্রত করাই ছিল খেলাফত আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। তা সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আলেমদের বর্ণাঢ্য অবদান সব যুগের মুসলমানের অনুপ্রেণার উৎস হয়ে আছে। মোগল শাসনের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এ দেশে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। বিশেষত ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ায় মুসলমানরা এক চরম বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এমন বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও ভারতীয় উপমহাদেশের আলেমরা ইসলামী শিক্ষার ধারা অব্যাহত রেখেছেন, যেন পরবর্তী প্রজন্ম দ্বিনবিমুখ হয়ে না যায়। (সংক্ষেপিত)