ভারতীয় উপমহাদেশে হাদিসের পাঠদান শুরু হয়েছিল যার মাধ্যমে
প্রকাশকালঃ
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১১:১২ পূর্বাহ্ণ ১৭৫ বার পঠিত
ভারতীয় উপমহাদেশে হাদিসের পাঠদান শুরু হয়েছিল শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.)-এর মাধ্যমে। তিনি হেজাজ গমন করেন এবং আরবের কয়েকজন শিক্ষকের কাছে হাদিস পড়েন, হাদিসের সনদ অর্জন করেন। ভারতবর্ষে ফিরে তিনি হাদিসের পাঠদান শুরু করেন। আমাদের জানা মতে, ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর আগে কেউ ‘সিহাহ সিত্তাহ’ তথা হাদিসের বিশুদ্ধতম ছয় কিতাবের পাঠদান করেননি।
তাঁর মাধ্যমেই এই বরকতময় কাজের সূচনা হয়েছিল। ভারতবর্ষের যেকোনো আলেমের কাছে আপনি হাদিস পড়লে তার সনদ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহ.) পর্যন্ত পৌঁছবে। এ ছাড়া তিনি ইয়েমেনি ও হিজাজি ধারায় সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমের পাঠদান এবং এগুলোর ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা ও টীকা সংযোজন করেছেন।
তাঁর দ্বিতীয় প্রধান অবদান ছিল কোরআনের অনুবাদ শুরু করা।
তাঁর আগে ভারতীয় আলেমরা স্থানীয় ভাষায় কোরআন অনুবাদ করাকে গুরুতর বিষয় মনে করত। আলেমদের ভেতরে একদল হয়তো ভুলত্রুটি হওয়ার ভয়ে কোরআন অনুবাদ থেকে দূরে ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা প্রবৃত্তি পূজারি ছিল, নেতৃত্বের লোভ ছিল যাদের ভেতর, তারা স্থানীয় ভাষায় কোরআন অনুবাদের বিরোধিতা করত ধর্মীয় নেতৃত্ব ছুটে যাওয়ার ভয়ে। তারা ভাবত, স্থানীয় ভাষায় কোরআনের অনুবাদ হলে আমাদের ওপর মানুষের নির্ভরতা কমবে এবং দ্বিন-ধর্ম বোঝার জন্য আমাদের কাছে আসার প্রয়োজন থাকবে না।
সুতরাং সাধারণ মানুষের ওপর আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে না। তাদের এই চিন্তা ছিল অত্যন্ত মূর্খতাসুলভ ও ধ্বংসাত্মক।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) স্থানীয় ভাষায় কোরআন অনুবাদে মনোযোগী হন। তাঁর দুই ছেলে উর্দু ভাষায় কোরআন অনুবাদ করেন। তাঁদের মধ্যে শাহ রফিউদ্দিন (রহ.)-এর অনুবাদ আক্ষরিক।
বিপরীতে শাহ আবদুল কাদের (রহ.)-এর অনুবাদ ছিল উপমাহীন। তাঁর অনুবাদ পড়লে আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাহায্যের ছাপ পাওয়া যায়। এখানে আমি শুধু দুটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা বলল, ফেরাউনের ইজ্জতের শপথ! আমরাই বিজয়ী হবো।’ (সুরা : আশ-শুআরা, আয়াত : ৪৪)
এখানে ‘ইজ্জত’ শব্দের উদ্দেশ্য নির্ণয় করাকে আল্লামা জামাখশারি (রহ.)-এর মতো তাফসিরবিদও দুরূহ মনে করেছেন। সাধারণত ইজ্জত শব্দের অর্থ করা হয় ফেরাউনের সম্মান ও প্রতিপত্তি। কিন্তু শাহ আবদুল কাদের (রহ.) দিল্লিতে বসবাস করতেন। তিনি দরবারি ভাষা ও পরিভাষা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি এর অনুবাদ করেন ‘ফেরাউনের সৌভাগ্যের বদৌলতে আমরা বিজয়ী হবো।’ কেননা রাজদরবারের তোষামোদির ভাষা এমনই হয়ে থাকে।
তিনি নিজেই বলেন, এমন আয়াত আমার সামনে আসত এবং আমি অর্থ বুঝতে পারতাম না, তখন আমি বাজারে চলে যেতাম এবং বোঝার চেষ্টা করতাম, মানুষ কিভাবে এর ভাব আদায় করে। শাহ আবদুল কাদের (রহ.) অনুবাদের পোশাকি সৌন্দর্য ও শ্রুতিমধুরতার প্রতিও লক্ষ রাখতেন। কেননা কোরআন শ্রুতিমধুর ও শিল্প-রসদে পরিপূর্ণ। আর এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই শব্দ-বাক্যের বাহ্যিক কাঠামো এর অর্থ ও উদ্দেশ্যকে প্রভাবিত করে।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (রহ.)-এর তৃতীয় প্রধান অবদান হলো নিষ্কলুষ একত্ববাদকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। তাঁর পৌত্র শাহ মুহাম্মদ ইসমাইল (রহ.) এ বিষয়ে ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ নামের একটি অতুলনীয় গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমার জানা মতে, এ বিষয়ে এর থেকে শক্তিশালী ও স্পষ্ট ভাষার দ্বিতীয় কোনো গ্রন্থ নেই। অনবদ্য এই বই সম্পর্কে আল্লামা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.) বলেছেন, এই বই পড়ে হাজার নয়, লাখো মানুষ সুপথের দিশা পেয়েছে। দারুল উলুম দেওয়াবন্দ ও মাজাহেরে উলুমের (ভারতের প্রধান দুই ইসলামী বিদ্যাপীঠ) পুরোধা আলেমরা এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।
শায়খুল হাদিস জাকারিয়া (রহ.) আমাকে ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ বইয়ের আরবি ভাষান্তরের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি তখন মদিনায় ছিলাম। মদিনা থেকে বিদায়ের প্রস্তুতিও ছিল। বাইরে গাড়ি রেখে মসজিদে নববীতে নামাজ আদায় করলাম। ইচ্ছা নামাজ শেষে বিদায় নেব। এরই মধ্যে শায়খুল হাদিস (রহ.) সংবাদ পাঠালেন, ভাষান্তরের কাজ শুরু করে যাও। আমি রওজায়ে আতহারের রিয়াজুল জান্নাতে বসে ভাষান্তরের কাজ শুরু করি। তখন আমার সামনে ছিলেন প্রিয়ভাজন মুহাম্মদ ওয়াজেহ। আমি স্পষ্টত অনুভব করলাম জান্নাতের হাওয়া বয়ে গেল এবং আমার এই বিশ্বাস দৃঢ় হলো যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কাছে এই বই ‘মাকবুল’ (গ্রহণযোগ্য)।
অনূদিত অংশ শায়খুল হাদিস জাকারিয়া (রহ.)-কে শোনালাম। তিনি অন্তর খুলে দোয়া করলেন। বইটির অনুবাদ শেষ হলে তা ‘রিসালাতুত তাওহিদ’ নামে প্রকাশিত হয়। আমি সৌদি আরবের একজন বড় আলেম, যিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, তাঁকে বইটি পড়তে দিই। সাধারণত আরবদের ধারণা, শায়খ আবদুল ওয়াহাব নজদি (রহ.) রচিত ‘কিতাবুত তাওহিদ’ এ বিষয়ে শ্রেষ্ঠ বই।
এ বিষয়ে এর থেকে শ্রেষ্ঠ কোনো বই আছে তা তারা মানতে প্রস্তুত নয়। তার পরও একজন আরব ও ওয়াহাবি হয়ে তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে শাহ মুহাম্মদ ইসমাইল শহীদ (রহ.) রচিত ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ একত্ববাদের ওপর রচিত সর্বোত্তম বই। এভাবে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) ও বংশধররা নিষ্কলুষ একত্ববাদ, কোরআনের প্রসার, হাদিসের পাঠদানে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) তাঁর ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে এখানেই সীমাবদ্ধ করেননি, বরং তিনি দূরদর্শিতার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন যে সামনের যুগ হবে বুদ্ধিবৃত্তির যুগ। বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে মানুষকে প্রভাবিত করা হবে। এ জন্য তিনি ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ রচনা করেছেন। যে বইয়ে তিনি ইসলামী শরিয়তের বিধি-বিধানগুলোকে যুক্তির আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং এগুলোর অন্তর্নিহিত কল্যাণ ও যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন। সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে এ বইটি প্রভাবিত করেছে।
বেশির ভাগ মানুষ জানে না ইংরেজসহ বিদেশি ও আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রকৃতপক্ষে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)-এর যুগেই শুরু হয়েছিল। মারাঠাদের প্রতিহত করতে তিনিই পারস্য থেকে আহমদ শাহ আবদালিকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি মারাঠাদের এমনভাবে পরাজিত করেছিলেন যে, ঐতিহাসিকরা লেখেন মারাঠাদের এমন কোনো ঘর ছিল না, যেখানে তখন মাতাম হয়নি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে শহীদ টিপু সুলতান (রহ.)-এর নাম অবিস্মরণীয়।
তিনি ইংরেজ বাহিনীর জয়যাত্রা থমকে দিয়েছিলেন। তিনি নানাভাবে সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর নানা শাহ আবু সাঈদ, তাঁর চাচা সাইয়েদ নোমান ও মামা সাইয়েদ আবুল লায়িস (রহ.)-এর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন তিনি। তাঁরা ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)-এর চিন্তা ও আদর্শের উত্তরাধিকারী।