কুমিল্লার খাদি কাপড়ের আদ্যোপান্ত

প্রকাশকালঃ ০৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:৩২ অপরাহ্ণ ৪১৭ বার পঠিত
কুমিল্লার খাদি কাপড়ের আদ্যোপান্ত

প্রাচীনকাল থেকে এই উপ-মহাদেশে হস্তচালিত খাদি বা খদ্দরের কাপড় ছিল জগদ্বিখ্যাত। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এই খাদি বা খদ্দরের কাপড় বিদেশেও রপ্তানি হতো। শতবর্ষের পথ পরিক্রমায় কুমিল্লার খাদি বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কুমিল্লার একটি অন্যতম ঐতিহ্য এই খাদি বা খদ্দর শিল্প। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ের রামঘাটলায় গেলেই দুপাশে দেখা মিলবে খাদি বা খদ্দর শিল্পের অনেকগুলো বিক্রয়কেন্দ্র। এছাড়া নগরীর খন্দকার প্লাজার পাশেও বেশ কয়েকটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। জেলার চান্দিনা উপজেলায় রয়েছে বেশ কিছু খাদি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। 

খাদি কাপড়ের অতীতঃ

১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় এ কাপড়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে উঠে। "স্বদেশী পণ্য গ্রহণ কর আর বিদেশী পণ্য বর্জন কর" এই শ্লোগানের ওপর ভিত্তি করেই তৎকালীন সময়ে খাদিশিল্পের সমৃদ্ধি হয়। তখন খাদি কাপড় তৈরি হতো রাঙ্গামাটির তূলা থেকে। কুমিল্লা জেলার চান্দিনা, দেবিদ্বার, বুড়িচং ও সদর থানায় সে সময়  প্রচুর খাদি কাপড় তৈরি হতো। বিদেশি বস্ত্র বর্জনে গান্ধীজীর আহ্বানে সে সময় কুমিল্লায় ব্যাপক সাড়া জাগে এবং খাদি বস্ত্র উৎপাদনও বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে কুমিল্লার খাদি বস্ত্র। এই বস্ত্র জনপ্রিয়তা অর্জন করে কুমিল্লার খাদি হিসাবে।

১৯২৬-২৭ সালে একটি ৮ হাত লম্বা ধুতি বিক্রি হতো মাত্র পাঁচশিকে দামে। সে সময় কুমিল্লা অভয় আশ্রম প্রায় ৯ লাখ টাকা মূল্যের খাদি কাপড় বিক্রি করেছিল। প্রয়াত রবীন্দ্র সংগীত বিশারদ, অভয় আশ্রমের একজন কর্মী পরিমল দত্তের লেখা থেকে জানা যায়, বিপুল চাহিদা থাকলেও অভয় আশ্রম থেকে সে চাহিদা সম্পূর্ণভাবে পূরণ হতো না।

খাদির চাহিদার কারণে দ্রুত তাঁত চালানোর জন্য পায়ে চালিত প্যাডেলের নিচে মাটিতে গর্ত করা হতো। এই গর্ত বা খাদ থেকে যে কাপড় উৎপন্ন হতো সেই কাপড়কে খাদি কাপড় বলা হতো। এভাবে খাদি নামের উৎপত্তি। ক্রমান্বয়ে এই কাপড় খাদি বা খদ্দর নামেও প্রসিদ্ধি লাভ করে।
 

খাদি কাপড়ের স্বর্ণযুগঃ 

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় খাদি শিল্পের ছিল স্বর্ণযুগ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বস্ত্রকলগুলো তখন বন্ধ। বস্ত্র চাহিদা মেটাতে আমদানি নির্ভর দেশে হস্তচালিত তাঁতের কাপড়ের উপর প্রচুর চাপ পড়ে। দেশের বা মানুষের চাহিদার তুলনায় খাদির উৎপাদন ব্যাপক না হলেও চান্দিনা বাজারকে কেন্দ্র করে আশ-পাশের গ্রামগুলোতে তাঁতীরা চাদর, পর্দার কাপড়, পরার কাপড় তৈরি করতে শুরু করে। কুমিল্লার ময়নামতি, চান্দিনা, গৌরীপুরসহ বেশ কিছু এলাকা খাদির জন্য বিখ্যাত ছিল। ময়নামতিতে তখন রঙিন খাদি কাপড়ের লুঙ্গি, শাড়ি, গামছা প্রস্তুত হতো।

খাদি শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও এই শিল্প মূলত কুটির শিল্প। গ্রাম্য বধূরা গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে ফাঁকে চরকায় সুতা কেটে তাঁতীদের কাছে বিক্রি করে বাড়তি আয়ের সুযোগ পেত। যে বৃদ্ধ লোকটি খেতে খামারে পরিশ্রম করতে পারত না, যে কিশোর- কিশোরী বাইরে শ্রম বিক্রির সুযোগ পেত না তারাও চরকায় সুতা কেটে সংসারে বাড়তি আয়ের সুযোগ পেত।
 

খাদি কাপড়ের মন্দাঃ 

আশির দশকের মাঝামাঝি দেশে ব্যাপক হারে পাওয়ার লুম ভিত্তিক বস্ত্র শিল্প গড়ে উঠে। ফলে অতুলা জাত বস্ত্রের প্রসার ব্যাপক হারে ঘটে। বেড়ে যায় পলিয়েস্টার, রেয়ন, ভিসকম এ্যাক্রেলিক সুতার ব্যবহার। রপ্তানি মুখী তৈরি পোশাকের জন্য আমদানি হতে থাকে শুল্ক মুক্ত বিদেশি বস্ত্র। এভাবে খাদি কাপড়ের ব্যবহার আজ অনেকটাই কমে গেছে। তবে খাদি কাপড়ের এ অবস্থার জন্য সংশ্লিষ্টরা দায়ী করছেন সুতার সংকট,কারিগর সংকট, পরিশ্রমের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং ব্র্যান্ডিংয়ের অভাব ও বিপণন অবকাঠামোর অভাবকে।
 

খাদি কাপড়ের বর্তমানঃ

কুমিল্লার সদর, চান্দিনা, দেবিদ্বার ও মুরাদনগরে হাজার হাজার তাঁতী এ শিল্পের প্রসারে একসময় কাজ করলেও বর্তমানে কিছু সংখ্যক তাঁতী কোনরকমে তাদের পেশা টিকিয়ে রেখেছে। চান্দিনার বারেরা, নুরীতলা, কলাগাঁয়ের কিছু কিছু পরিবার তুলা থেকে সুতা বানানোর কাজ করছে। এপেশার লোকজন ওইসব পরিবার থেকে সুতা কিনে খাদি তৈরি করতো। বর্তমানে ওইসব এলাকাতেও খুব একটা সুতা তৈরি হয়না। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ থেকে সুতা এনে খাদি কাপড় তৈরির কাজটা চলছে। একসময় দেবিদ্বারের বরকামতায় ৫০টির বেশি তাঁত ছিল। বর্তমানে ১৫-২০টি তাঁত চালু রয়েছে। বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মেও খাদি কাপড় বিক্রয় হচ্ছে যা এই শিল্পকে প্রসারিত করতে বিরাট ভূমিকা রাখছে।

সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে বাহারি রঙ ও নকশার খাদির পোশাক হাল ফ্যাশনে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।কালের বিবর্তনে এখন তা তৈরী হচ্ছে মেশিনেও। তাঁতের খাদির মতো মেশিনে তৈরী খাদিও পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক রুচিশীল পোশাক তৈরি করে আনা হয়েছে। মিহি সুতার সঙ্গে মোটা সুতার ব্র্যান্ড এবং খাদির সঙ্গে রকমারি সুতার চেক বুনে কাপড়েও বৈচিত্র্য আনা হয়েছে। আবার ব্লক দিয়েও তৈরি করা হয়েছে সুন্দর পোশাক। দামও ধরা হয়েছে মোটামুটি ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে।

এক সময় খাদি কাপড় শালেই বেশি ব্যবহার করা হলেও এখন ব্যবহারে এসেছে বৈচিত্র্য। ফ্যাশন ডিজাইনারদের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে খাদির পাঞ্জাবি, ফতুয়া, শার্ট, থ্রি-পিস,শাড়ি, স্কার্ট,পছন্দমতো বানানোর জন্য আছে থানকাপড়, বিছানার চাদর, গায়ের চাদর এবং ব্যাগ, টুপি, গলাবন্ধনীসহ ব্যবহার্য অন্যান্য পোশাক। আবার খাদি কাপড়ের রং, নকশা ও বুনন বৈচিত্র্য এ পণ্যের চাহিদাও বাড়িয়ে দিয়েছে।

 

খাদিশিল্পের প্রসারে সংশ্লিষ্টরা বলছেন খাদির সুতা প্রচুর পরিমানে তৈরি করতে হবে। খাদি দিয়ে আরো উন্নত কী ধরণের প্রেডাক্ট তৈরি করা যায় এসব ব্যাপারে পরিকল্পনা করে এগুতে হবে।  খদ্দরের কাপড়ে আছে স্বদেশ প্রেমের পরিচয়। ক্রেতারাও দেশি পণ্য ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। তবেই কুমিল্লার ঐতিহ্যের খাদির সম্ভাবনার দুয়ার আবার খুলে যাবে।