শুল্ক-করছাড় কমানোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। তবে বেশির ভাগ করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫-২৬ সালে শেষ হচ্ছে।
সরকার বহু বছর ধরে উদ্যোক্তা, আমদানিকারকসহ ব্যবসায়ীদের করছাড় দিয়ে আসছে। কিন্তু এবার দেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) করছাড় কমানোর শর্ত আরোপ করেছে। তবে আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে করছাড় কমানোর বড় কোনো উদ্যোগ থাকছে না। কারণ, দেশে বেশির ভাগ করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫-২৬ অর্থবছর নাগাদ শেষ হয়ে যাবে। সেই অবধি এসব করছাড় বহাল রাখতে চায় সরকার।
আইএমএফের শর্তের ওপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তৈরি অবস্থানপত্র বিশ্লেষণ এবং সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এনবিআর সূত্রমতে, আগামী বাজেটে এমন একটি ঘোষণা থাকতে পারে যে কিছু কিছু খাতে করছাড় বা অব্যাহতির বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তা আর বাড়ানো হবে না।
আইএমএফের শর্ত হলো, শুল্ক-কর অব্যাহতির পরিমাণ কমাতে হবে। কর অব্যাহতি কমিয়ে সরকারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে খরচ করার সামর্থ্য বাড়াতে বলেছে সংস্থাটি। এনবিআর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সরকার বছরে গড়ে আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো কর অব্যাহতি দেয়।
দুই শর মতো প্রজ্ঞাপন দিয়ে শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর খাতে এসব ছাড় দেওয়া হয়। এই তালিকায় আছে, উৎপাদন, সেবা ও কৃষি খাত। এ ছাড়া চিকিৎসাসামগ্রী ও ভোগ্যপণ্যের মতো অতিপ্রয়োজনীয় খাতেও কর সুবিধা দেওয়া হয়। তবে আগামী কয়েক বছরে কিছু কিছু করছাড়ের সুবিধা তুলে দেওয়া দেওয়ার পরিকল্পনা করছে এনবিআর।
শুল্কছাড় যৌক্তিক করা এবং রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে এনবিআর ও আইএমএফের একটি দল যৌথভাবে কাজ করছে। এনবিআরের আয়কর বিভাগের সদস্য সামস উদ্দিন আহমেদ এনবিআরের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার যেহেতু একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ ধরনের করছাড় দিয়েছে, সেই মেয়াদ পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। কারণ, উদ্যোক্তারা এসব ছাড়ের মেয়াদ দেখেই বিনিয়োগ করেছেন। এটা আইএমএফকে বোঝানো যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘করছাড়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা তদবির শুরু করতে পারেন। এই তদবির ঠেকাতে হবে।’
রিটার্ন জমা ৩০% বাড়ানোর লক্ষ্য
আইএমএফের আরেকটি শর্ত হচ্ছে, আয়করের জাল বিস্তৃত করা। এনবিআরের অবস্থানপত্র অনুযায়ী, আইএমএফের এই শর্ত পূরণে আগামী অর্থবছরে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের রিটার্ন জমার সংখ্যা ৩০ শতাংশ বাড়াতে চায় এনবিআর। পরবর্তী বছরেও এই ধারা বজায় রাখার পরিকল্পনা করছে এনবিআর।
এ ছাড়া এনবিআরের অবস্থানপত্রে আইএমএফের শর্ত পূরণে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে করের ভিত্তি বাড়াতে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্র বা খাত ছয়টি বাড়িয়ে ৪৪টি করা হচ্ছে। বর্তমানে ৩৮ ধরনের সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানো বাধ্যতামূলক। আগামী বাজেটে সারচার্জের ভিত্তি ও হার কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে।
ডিজিটাল অর্থনীতি থেকে কর বাড়াতে একটি বিশেষ ডিজিটাল ডাইরেক্ট ট্যাক্স ইউনিট গঠনের ঘোষণা থাকতে পারে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক কর ইউনিট ও ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের জন্য আলাদা ইউনিট গঠনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এনবিআর মনে করছে, আয়কর খাতে এসব সংস্কারের ফলে আগামী তিন বছরে কর আদায়ের পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে।
ভ্যাটের হারের সংখ্যা কমানো হবে
এনবিআরের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে আইএমএফের প্রতিনিধিরা ভ্যাট হারের সংখ্যা কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। বর্তমানে ভ্যাটের হার সাতটি। এগুলো হলো ০, ২, ২.৪, ৫, সাড়ে ৭, ১০ ও ১৫ শতাংশ। এনবিআরের কর্মকর্তারা আইএমএফকে আশ্বস্ত করেছেন যে আগামী কয়েক বছরে ভ্যাট হারের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে। অবশ্য নতুন ভ্যাট আইন চালুর সময়ে অভিন্ন ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার করার পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফ।
ভ্যাট আদায় বাড়াতে তামাকজাত পণ্য খাত থেকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির কথা বলছে এনবিআর। সে অনুযায়ী আসন্ন বাজেটে সিগারেটসহ তামাকজাতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক-কর বাড়বে। বর্তমানে মোট ভ্যাট আদায়ের ৩০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে।
এনবিআর আইএমএফকে বলেছে, ভ্যাট আদায় বাড়াতে পরবর্তী দুই বছরে আরও পাঁচটি ভ্যাট কমিশনারেট গঠন করা হবে। আগামী বছর ৬০ হাজার ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানো হবে।
আইএমএফের আরেক শর্ত হলো, আগামী ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এনবিআরকে স্বাভাবিক প্রবণতার অতিরিক্ত হিসেবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ পরিমাণ অর্থ আদায় করতে হবে। সে আলোকে এনবিআর হিসাব করে দেখেছে, আগামী অর্থবছরে তাদের অতিরিক্ত ৪৮ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে।
আবার আসছে আইএমএফের দল
কয়েক মাস ধরে এনবিআর রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কৌশল নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করে আসছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রাজস্ব খাত সংস্কারে বাজেটের পর জুন মাসেই আইএমএফের একটি কারিগরি দল আসবে।
ওই দল কোন খাতে কী ধরনের সংস্কার করা যেতে পারে, তা নিয়ে কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফ অটোমেশন তথা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা জোরদারেই বেশি গুরুত্ব দেবে।