আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:-
বাবা-মা হারা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া নাতনিকে নিয়ে অভাবের সংসার ষাটোর্ধ্ব কাদেমার। টানাটানির সংসারে ছাগল ও আর হাঁস-মুরগি পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন এই নারী। ঢাকায় শ্রমিকের কাজ করা ছেলের কাছে সামান্য সহযোগিতা পেলেও তা দিয়ে সংসারে থাকা নাতনির পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারছেন না। আবার উপযুক্ত বয়স না হওয়ায় নাতনিকে বিয়ে দিতেও পারছেন না।
এ নিয়ে উভয় সংকটে থাকা কাদেমা বলেন, ‘বাপ-মা হারা নাতনি নিয়া থাকি। মাইনষে বিয়া দিবার কয়। কিন্তু এই অল্প বয়সে কেমন করি বিয়া দিই। নাতনি পড়াশোনা করবার চায়। খরচ জোগাইতে কষ্ট হয়। বাড়িত হাঁস-মুরগি আর ছাগল আছে। কেমন করি আর একটু বেশি আয় করা যায়, এজন্য প্রশিক্ষণ নিবার আসছি।’
কাদেমার বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুরের ধরনীবাড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ মধুপুর গ্রামে। এই বৃদ্ধা নারীর সঙ্গে কথা হয় আরডিআরএসের চাইল্ড নট ব্রাইড (সিএনবি) প্রকল্পের বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা কিশোরীদের পরিবারের আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণে। শনিবার (২৩ আগস্ট) দুপুরে উলিপুরের দুর্গাপুর ফেডারেশন ভবনে চার দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের শেষ দিন ছিল। সেখানে অংশ নিয়েছেন কাদেমা ও বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা কিশোরীদের ২০টি পরিবারের অভিভাবক। উদ্দেশ্য, পারিবারিক খামার, সবজি বাগান কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসা করে পরিবারের আয় বৃদ্ধি করা এবং বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা কিশোরীদের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া।
কাদেমার মতো প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন শাহনাজ বেগম। এই নারীর সংসারে আছে দিনমজুর স্বামী ও দুই মেয়ে। বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। ছোট মেয়েকে কোলে নিয়েই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন শাহনাজ।
উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের আপুয়ারখাতা গ্রামের বাসিন্দা শাহনাজের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো তিনি জীবন সংসার নিয়ে বেশ সচেতন। কিন্তু স্বামীর স্বল্প আয়ে সংসার খরচ মিটিয়ে মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছেন। অভাবের তাড়নায় মেয়েকে যাতে বাল্যবিয়ে দিতে না হয়, সেজন্য সংসারের আয়বৃদ্ধির কৌশল জানতে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন।
শাহনাজ বলেন, ‘স্বামীর নিয়মিত আয় হয় না। হাঁস-মুরগি পালন করি। কিন্তু কেমন করে নিয়মমাফিক পালন করতে হয়, সেটা জানা ছিল না। এখানে প্রশিক্ষণ নিতে এসে অনেক কিছু শিখলাম। কখন হাঁস-মুরগির ডিম ফুটাতে দিতে হবে, কোন রোগের কী লক্ষণ, চিকিৎসা কী এসব জানছি। আগে এসব জানা ছিল না। এখন সাহস পাচ্ছি। পারিবারিক সবজি বাগান নিয়া জানছি। নিজের জমি নাই। যদি জমি বর্গা পাই তাহলে সবজিও চাষ করবো।’
মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়ে শাহনাজ বলেন, ‘নিজেদের কষ্ট হইলেও পড়াশোনা করাবো। পরিবারের আয় বাড়লে মেয়েকে পড়াশোনা করাতে পারবো। ভুল করেও বাল্যবিয়ে দেবো না।’
প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন ঝালমুড়ি বিক্রেতা শাহীনসহ আরও বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ। আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অংশ নেওয়া প্রত্যেকের বাড়িতে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা কিশোরী রয়েছে। স্বাবলম্বী হতে সিএনবি প্রকল্পের মাধ্যমে এসব পরিবারকে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
প্রশিক্ষণে কী জানলেন তারা:-
প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া নারী-পুরুষ ও সিএনবি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম থেকে প্রায় ৪৭০টি পরিবার প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। সর্বশেষ চার দিনব্যাপী এই প্রশিক্ষণে দুর্গাপুর ফেডারেশন ভেন্যুতে চার ইউনিয়নের দরিদ্র পরিবারের ২০ জন নারী-পুরুষ অংশ নিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েশিশু রয়েছে। সংসারের অভাব-অনটনের কারণে যাতে সন্তানদের বাল্যবিয়ে না দেন, সেজন্য প্রকল্পের আওতায় এসব ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের সদস্যদের আয়বৃদ্ধির জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাঁস-মুরগি পালন, ছাগল পালন, বসতবাড়িতে শাক-সবজি চাষ ও সংকট মোকাবিলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
শুধু প্রশিক্ষণ নয়, অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে প্রকল্পের পক্ষ থেকে এককালীন আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হবে, যাতে তারা প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে আয়বৃদ্ধিমূলক ক্ষুদ্রব্যবসা কিংবা উৎপাদমূলক কাজ শুরু করতে পারেন।
সিএনবি প্রকল্পের জেলা সমন্বয়কারী অলিক রাংসা বলেন, ‘এনআরকে-টেলিথন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এই প্রকল্পে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করছে। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ বিশেষ করে, কুড়িগ্রাম জেলায় বাল্যবিয়ে ও জোরপূর্বক বিয়ের হার কমিয়ে আনা। এই প্রকল্পের একটি অংশ হলো বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা মেয়ে শিশুদের পরিবারের আয়বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। যাতে পরিবারগুলো মেয়ে শিশুদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে পারে, বোঝা মনে করে বাল্যবিয়ে না দেয়। সেই লক্ষ্য অর্জনের অংশ হিসেবে এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।’