নতুন বাজেটে বাধ্য হয়েই আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপ রাখা হচ্ছে, থাকছে কিছু সংস্কারের ঘোষণাও।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার শর্ত পূরণের প্রতিফলন থাকছে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে। তবে ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ যা যা করতে বলেছে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাজেট বক্তব্যে সেগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করার ঘোষণা থাকবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ কথা জানা গেছে।
সরকার নিজের মতো করেই এত দিন বাজেট প্রণয়ন করে আসছিল। গত ৩০ জানুয়ারি ঋণ অনুমোদনের পর নতুন বাজেটে এখন বাধ্য হয়েই আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপ রাখা হচ্ছে। থাকছে কিছু সংস্কারের ঘোষণাও। তবে অর্থমন্ত্রী এসব সংস্কারের সঙ্গে আইএমএফকে জড়িয়ে কিছু বলবেন না।
আইএমএফের ঋণের একটা অংশ আসছে লেনদেনের ভারসাম্য বজায়ের সহায়তা হিসেবে। ঋণের প্রথম কিস্তি মাত্র পাওয়া গেছে। সংস্কারের পদক্ষেপ না থাকলে আটকে যাবে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়া। চলমান ডলার-সংকট তখন আরও বড় আকারে দেখা দেবে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারাই এসব কথা জানান।
আগামী বাজেট করা হচ্ছে ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার। ‘উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’ শীর্ষক বাজেট বক্তব্য দেবেন অর্থমন্ত্রী। এতে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সমাজ করার কথা তুলে ধরবেন তিনি।
বাজেট ঘাটতি ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার থাকছে যথাক্রমে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) প্রবৃদ্ধির হার ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ আর মূল্যস্ফীতির বার্ষিক হারের লক্ষ্য থাকবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ কোটি টাকা, যার মধ্যে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আগামী ১ জুন জাতীয় সংসদে এ বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী।
তবে আইএমএফ সাড়ে তিন বছরের জন্য দিয়েছে মোট ৩৮টি শর্ত, যার অর্ধেকের কম আগামী অর্থবছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে সুদের হারে করিডর পদ্ধতি তৈরি, রিজার্ভের যথাযথ গণনা পদ্ধতি প্রণয়ন, মুদ্রা বিনিময় হারের একটি দর রাখাসহ কয়েকটি শর্ত পূরণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলোর কিছু বাস্তবায়নের ঘোষণা আসবে আগামী জুন মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়, কিছু আসবে জুলাইয়ে। আইএমএফের চাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গতকাল শনিবার মুঠোফোনে এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে অবশ্যই আইএমএফের পরামর্শগুলোর প্রতিফলন থাকবে। করণীয়গুলোর কিছু কিছু এরই মধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। কিছু কিছু বাস্তবায়ন হবে আগামী বাজেটের এক বছরে।’
আইএমএফ চায় ভর্তুকি কমুক, সেটা তো আর কমছে না—এমন প্রশ্নের জবাবে এম এ মান্নান বলেন, কিছু ভর্তুকি কমবে, তবে সব না। যেমন খাদ্য ভর্তুকি বাড়বে। এটা বাড়াতেই হবে।
আইএমএফের চাওয়া বাস্তবায়নে সরকার
প্রতি অর্থবছরেই রাজস্ব আদায়ের হার বাড়ছে। তবে বৃদ্ধির হার কম। আইএমএফ বলেছে, স্বাভাবিক বৃদ্ধির চেয়ে আগামী অর্থবছরে যাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় দশমিক ৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আয় বাড়ে, সেই কৌশল প্রণয়ন করতে হবে আগামী মাস জুনের মধ্যে। আর এনবিআরকে শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট করতে হবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগকে বলা হয়েছে, মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি যাতে না হয় সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া ঋণ। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। একই সময়ের মধ্যে প্রণয়ন করতে হবে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের সময়ভিত্তিক সূত্র।
আইএমএফ বলেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আর ব্যাংক কোম্পানি আইন সংসদে উপস্থাপন করতে হবে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে।
এ ছাড়া সেপ্টেম্বরের মধ্যে একটি টেকসই গণ খাতে ক্রয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে বলেছে আইএমএফ। সংস্থাটি এ ছাড়া রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা, বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে পুনঃ তফসিল করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা এবং ভর্তুকি কমিয়ে আনার কৌশল তৈরির শর্ত দিয়েছে।
অর্থ বিভাগ ও এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সঞ্চয়পত্র, জিডিপির তথ্য প্রকাশ, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংসদে নেওয়া, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের সূত্র তৈরিসহ প্রায় সব কটিই আইএমএফের চাওয়া সময়ের মধ্যেই সরকার বাস্তবায়ন করবে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তব্যে এসব বিষয়ে ইতিবাচক ও আশাবাদের কথা তুলে ধরবেন।
এনবিআরের রাজস্ব বৃদ্ধির উপায়গুলো
আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী আগামী অর্থবছরে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়তি রাজস্ব বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ঘোষণা দেবেন অর্থমন্ত্রী। এনবিআর ইতিমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানা গেছে।
রাজস্ব আয় বৃদ্ধি নিয়ে আইএমএফের শর্ত পূরণ সম্পর্কিত এনবিআরের নথি অনুযায়ী মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট), আয়কর ও শুল্ক—এ তিন অংশেই রাজস্ব বৃদ্ধিতে নতুন কৌশল আরোপ করা হবে আগামী অর্থবছরে। রাজস্ব ফাঁকি রোধেও এনবিআর তৎপর থাকবে বলে জানানো হবে।
সূত্রগুলো জানায়, আয় বৃদ্ধির জন্য ৬০ হাজার ইলেকট্রনিক ফিশক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) কেনা হবে আগামী অর্থবছরে। পরের পাঁচ বছরে এ সংখ্যা তিন লাখে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া ভ্যাট বিভাগের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনা হবে। বর্তমানের ১২টির পাশাপাশি আরও ৫টি ভ্যাট কমিশনারেট তৈরি করা হবে, যাতে আসবে অতিরিক্ত আয়।
অর্থমন্ত্রীকে এনবিআরের পক্ষ থেকে আইএমএফের শর্ত পূরণের কথা উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, রাজস্ব আয় বাড়াতে এনবিআরের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় সহায়তা, অবকাঠামো উন্নয়ন, রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রণোদনা ইত্যাদি বিষয়ে আগামী অর্থবছরে জোর দেওয়া হবে। এ ছাড়া কমানো হবে কিছুটা কর অব্যাহতি। এতেও কিছু আয় বাড়বে। এনবিআর আরও বলেছে, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদদের সংস্থা আইসিএবির সঙ্গে এনবিআর যৌথভাবে কর ফাঁকি রোধে কাজ করছে। পাশাপাশি ঢাকার বাইরে তৃণমূল পর্যায়ে স্থাপন করা হচ্ছে কিছু কর কার্যালয়।
এদিকে কর তেমন না বাড়লেও আগামী অর্থবছরে আয়কর রিটার্ন জমা অন্তত ৩০ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করছে এনবিআর। অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, রাজস্ব বৃদ্ধিতে এনবিআরের উপায়গুলো নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্য থাকবে।
আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এসব বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশকে আইএমএফ খুব একটা কঠিন শর্ত দেয়নি। ফলে আগামী অর্থবছরে অনেক শর্তই পূরণ হয়ে যাবে। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে, সরকার ব্যর্থ হতে পারে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও রিজার্ভ সংরক্ষণের দুই শর্ত পূরণে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির বিষয়টি যদিও অর্থবছর শেষ না হলে মূল্যায়ন হবে না। তবে যথেষ্ট প্রস্তুতি না নিলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি প্রায় অসম্ভব হবে। আগামী জুন, সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর—কোনো মাসেই রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’
আহসান মনসুর আরও বলেন, পুরোনো দায়ের কারণে ভর্তুকি এবার বাড়বে এবং বাজেটে বরাদ্দও বাড়বে। তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম যে হারে কমেছে, পরেরবার আর ভর্তুকি বাড়বে না।