অনেক ব্যবসায়ী এমনিতেই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছেন না। কারণ, ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ শোধ না করেও ঋণখেলাপি না হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সুবিধার কারণে সময়মতো ঋণের টাকা ফেরত না পেয়ে অনেক ব্যাংক পড়েছে তারল্যসংকটে। এমন এক পরিস্থিতিতে ব্যাংকঋণ পরিশোধে আবারও বড় ছাড় দিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছে, আগামী জুনের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিলেই কোনো গ্রাহককে আর খেলাপি করা যাবে না। ফলে যারা ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ না করে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, তাঁরা এখন কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক থাকতে পারবেন। তবে শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এই সুবিধা মিলবে। সাধারণত ব্যবসা শুরু বা শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে মেয়াদি ঋণ নেওয়া হয়। গতকাল জারি করা প্রজ্ঞাপনে এসব তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বর্তমানে ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা মেয়াদি ঋণ।
ঋণ পরিশোধে দেওয়া এ সুবিধার কারণ সম্পর্কে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘বহির্বিশ্বে যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ঋণগ্রহীতারা কিস্তির সম্পূর্ণ অংশ পরিশোধে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে উৎপাদন ও সেবা খাতসহ সব ব্যবসা চলমান রাখার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা বজায় রাখতে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে নতুন নির্দেশনা অনুসরণীয় হবে।’
জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঢালাওভাবে এই সুবিধা দেওয়া ঠিক হবে না। এতে ব্যাংকের পাশাপাশি গ্রাহকও বিপদে পড়বেন। যদি কোনো গ্রাহক প্রমাণ করতে পারেন তাঁদের ব্যবসা খারাপ, তখন এই সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। এভাবে বারবার ঢালাও সুবিধা দেওয়ায় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ও প্রকৃত আর্থিক চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে না। এটা আর্থিক খাতের জন্য খুবই খারাপ।
খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিশেষ এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যাতে নতুন করে কেউ খেলাপি হয়ে না পড়েন এবং খেলাপি ঋণ না বাড়ে। বাংলাদেশ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে, তাতে খেলাপি ঋণ কমানোর শর্ত জুড়ে দিয়েছে সংস্থাটি। সাবেক ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণখেলাপিদের বারবার এ ধরনের সুবিধা দিয়ে ব্যাংক খাতকে ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে। এতে আমানতকারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামাল ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় চাপে পড়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। এ জন্য স্বল্প সময়ের জন্য এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে নির্বাচন বা আইএমএফের শর্তের কোনো সম্পর্ক নেই।’
কারা পাবেন এই সুযোগ
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এবারের এই সুযোগ পাবেন এপ্রিল-জুন সময়ে যাঁদের কিস্তি দেওয়ার সময় হয়েছে, শুধু তাঁরাই। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গত ১ এপ্রিল থেকে বিদ্যমান নিয়মিত মেয়াদি ঋণের (স্বল্পমেয়াদি কৃষি ও ক্ষুদ্রঋণসহ) বিপরীতে এপ্রিল-জুন সময়ের জন্য যে কিস্তি দিতে হবে, তার ৫০ শতাংশ পরিশোধ করলেই গ্রাহককে খেলাপি করা যাবে না। যেসব গ্রাহক এ সুবিধা নেবেন, তাঁদের কিস্তির বাকি অংশ ঋণের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিন মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এই নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে, তাঁকে নিয়ম মেনে ঋণখেলাপি করা যাবে। তবে সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের ক্ষেত্রে ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত কোনো ধরনের সুদ বা মাশুল আরোপ করা যাবে না।
এর আগে ঋণ পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে যেসব গ্রাহক ঋণখেলাপি থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তাঁরাও এ সুবিধা পাবেন। ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের একই সুবিধা দিতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া এ সুবিধার বিপরীতে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ সুদ বা মুনাফা নগদে আদায় করবে, তা তারা আয় হিসাবে দেখাতে পারবে।
বাড়ছে খেলাপি ঋণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি-মার্চে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। ফলে গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণ কমানোর পথ খুঁজছে।
এদিকে আইএমএফ ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে। এখন বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের কম হলেও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে তা ২০ শতাংশের বেশি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংককে চলতি জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক চারটি হলো সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী।
প্রকৃত চিত্র আড়ালে থাকছে
বারবার ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ায় খারাপ গ্রাহকদের পাশাপাশি ভালো গ্রাহকেরাও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। এতে ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে পড়েছে। নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে অনেক ব্যাংক। এ ছাড়া নানা সুবিধার কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়ালে থেকে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতে কী পরিমাণ আদায় অনুপযোগী ঋণ রয়েছে এবং ঋণ নেওয়া কত কোম্পানি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, তা জানা যাচ্ছে না। আবার এ ধরনের সুযোগে ব্যাংকমালিকেরা নিজ ব্যাংক ও একে অপরের ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ বের করে নিচ্ছেন, যেসব ঋণও আদায় হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, ‘এসব সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক বিবেচনা নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দাবি করতে পারে পণ্য ও জ্বালানি খরচ বেড়ে গেছে। তবে বাস্তবতা হলো, এ ধরনের সুবিধা পেয়ে ঋণ শোধ না করার একধরনের চর্চা গড়ে উঠেছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তাই নতুন করে আবারও সুবিধা দেওয়ায় দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংকগুলো ঝুঁকিতে পড়বে। যাঁরা বছরের পর বছর ঋণ শোধ করছেন না, তাঁরা আদৌ শোধ করবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সে ক্ষেত্রে আর্থিক খাতের পরিস্থিতি কোথায় যাবে, সেটা ভেবে দেখা দরকার।’