যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের অবনতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য নতুন করে সাজাচ্ছে আইফোন নির্মাণকারী তাইওয়ানের কোম্পানি ফক্সকন। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে চীন থেকে উৎপাদন সরাতে হচ্ছে ফক্সকনকে। এ বাস্তবতায় কোম্পানিটি ভাবছে, বৈদ্যুতিক গাড়ি হবে তাদের উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি। খবর বিবিসির।
বিবিসির সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ফক্সকনের চেয়ারম্যান ইয়াং লিউ কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের-চীন সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার কারণে তাদের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
খারাপ পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, তার একটি রূপকল্পও ভেবে রেখেছেন লিউ। তিনি বলেন, চীন তাইওয়ানকে অবরোধ করতে পারে।
ইয়াং লিউ বলেছেন, ব্যবসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পরিকল্পনা ইতিমধ্যে করা হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু পণ্যের উৎপাদন চীন থেকে মেক্সিকো ও ভিয়েতনামে সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে।
ইয়াং লিউ সম্ভবত ডেটা সেন্টারে ব্যবহৃত সার্ভারের কথা বলেছেন, যেখানে সংবেদনশীল তথ্য থাকতে পারে।
১৯৭৪ সালে টেলিভিশনের নব তৈরির মাধ্যমে ফক্সকনের যাত্রা শুরু হয়। এখন তারা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী প্রযুক্তি কোম্পানি, যাদের বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ ২০০ বিলিয়ন বা ২০ হাজার কোটি ডলার।
অ্যাপলের আইফোন প্রস্তুতকারক হিসেবেই ফক্সকনের বিশেষত্ব—অ্যাপলের অর্ধেকের বেশি পণ্য তারা প্রস্তুত করে। এ ছাড়া মাইক্রোসফট, সনি, ডেল ও আমাজনের মতো কোম্পানিও তার গ্রাহক। চীনে তাদের উৎপাদন কারখানা ছিল, কিন্তু এখন তারা চীন থেকে উৎপাদন কার্যক্রম সরিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে।
বিষয়টি হচ্ছে, ব্যবসা ঝুঁকিমুক্ত করতে পশ্চিমারা বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানিকে চীন থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান অনেক দিন ধরেই জানিয়ে আসছে। তবে চীনের ওপর উৎপাদন-নির্ভরশীলতা কমানোর এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এখনো বাস্তবে রূপ পায়নি।
লিউ বলেন, চীন থেকে উৎপাদন কার্যক্রম সরিয়ে আনতে কিছু বিদেশি গ্রাহকের চাপ আছে, তবে এটা তাদের সিদ্ধান্ত, ফক্সকনের নয়। ওই সব কোম্পানির ওপর আবার সেই সব দেশের সরকারের চাপ ছিল। তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি, যখন তারা সেই সিদ্ধান্ত নেবে, তখন তারা ফক্সকনকে জানাবে।
আইফোন উৎপাদনে যে দক্ষতা ফক্সকন অর্জন করেছে, এখন সেটা তারা বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের কাজে লাগাতে চায়।
ইয়াং লিউয়ের আশাবাদের কারণ হলো বৈদ্যুতিক গাড়ির যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। বিবিসিকে তিনি বলেন, তেলের বা গ্যাসের গাড়িতে যেখানে ইঞ্জিন থাকে, সেখানে বৈদ্যুতিক গাড়িতে আছে কেবল ব্যাটারি ও মোটর।
ফক্সকন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বের বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারের ৫ শতাংশ ধরতে চায়, যদিও এখন পর্যন্ত তারা হাতে গোনা কয়েকটি মডেল বানিয়েছে। ইয়াং লিউ বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে রীতিমতো জুয়া খেলছেন। তবে তিনি আশাবাদী, এই জুয়া খেলা থেকে তিনি বড় কিছু পাবেন।
বিবিসিকে লিউ আরও বলেন, বৈদ্যুতিক গাড়ির সব যন্ত্রাংশ এক জায়গায় বানাতে হবে, এমন কোনো কথা নেই, অর্থাৎ নানা জায়গায় এর উৎপাদন হবে, সেটাই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি ভারতের ফক্সকনের গাড়ি কারখানা থাকবে—এমন কথাই বলেন তিনি।
তবে আপাতত ফক্সকন যে কাজে সবচেয়ে ভালো, সে কাজটিই করবে। তারা মূলত ভোক্তাদের জন্য ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন করবে। তবে সেদিন আর খুব দূরে নয়, যেদিন তারা ভোক্তাদের জন্য বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন করবে।
উৎপাদন বহুমুখীকরণের সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহব্যবস্থাও বহুমুখীকরণ করবে ফক্সকন। লিউ মনে করেন, কোম্পানির ভবিষ্যতের জন্য এই উভয় ক্ষেত্রের বহুমুখীকরণ প্রয়োজনীয়।
এত দিন তারা মূলত বহুজাতিক কোম্পানির ওপর ভর করে ব্যবসা পরিচালনা করেছে। অর্থাৎ এরা যুক্তরাষ্ট্রে বসে পণ্যের ডিজাইন করত এবং চীনে উৎপাদন করে সারা বিশ্বে বিক্রি করত। এ প্রক্রিয়ায় টেলিভিশনের নব তৈরি থেকে শুরু করে আজ তারা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইলেকট্রনিক কোম্পানি।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার কারণে বিপাকে পড়েছে ফক্সকন। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে উলুখাগড়ার প্রাণ যায়, তাদের অবস্থা এখন অনেকটা সে রকম।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিবাদের অনেক কারণ আছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো তাইওয়ান, যেখানে ফক্সকনের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।