ইসলামী বার চন্দ্র মাসের মধ্যে পবিত্র শা’বান মাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ মাসের ১৫ তারিখের রাত উল্লেখযোগ্য পাঁচ রাতের একটি যার ভিত্তি ও তাৎপর্য কুরআন, সুন্নাহ ও ফোকাহায়ে কিরামের অভিমত দ্বারা প্রমাণিত। এতদসত্ত্বেও কতিপয় আলেম বিভিন্ন মিডিয়া যেমন ইন্টারনেট, টিভি, পুন্তিকা, পত্রিকা ইত্যাদির মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, যা আদৌ সঠিক নয়। এ কারণে ‘লাইলাতুল বরাত’ বা শবে বরাত উদ্যাপনের ভিত্তি ও তাৎপর্য পবিত্র কুরআন, সুন্নাহ্ ও ফোকাহায়ে কিরামের সুস্পষ্ট অভিমত দ্বারা প্রমাণ করাই এ প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য।
‘শবে বরাত’ পাঁচটি মর্যাদাপূর্ণ রাতসমূহের একটি। এ রাত ইবাদতের রাত হিসেবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র যুগ থেকে স্বীকৃত হয়ে আসছে। এ রাত স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করেছেন। তাই এ রাতে ইখলাছের সাথে আমল করা অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে কুরআন, সুন্নাহ ও ফোকাহায়ে কিরামের অভিমত তুলে ধরেছি,যাতে পাঠকরা সহজেই এ রাতের মর্যাদা বুঝতে পারে।
পবিত্র কুরআনের আলোকেঃ- মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন
“নিশ্চয় আমি এটি(কুরআন মাজিদ) নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে; অবশ্য আমি সতর্ককারী। সেই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজের ফয়সালা হয়।”(সূরা আদ-দুখানঃ৩)
এ আয়াতখানা ‘শবে বরাত’র মর্যাদা সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। এটি প্রখ্যাত তাবেঈ হযরত ইকরামাহ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু সহ এক দল মুফাস্সিরীনে কিরামের অভিমত। সকল তাফসীরকারক এ মতটি তাঁদের স্বীয় তাফসীরে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের অভিমত থেকে বোঝা যায় যে, ‘লাইলাতুল বরাতের’ কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে।( ইমাম কুরতুবী,তাফসীরে কুরতুবী, দারুল কুতুব আল-মিসরিয়্যাহ, মিশর, ২য় সংস্করণ, ১৩৮৪ হি:, খ. ১৬, পৃ: ১২৬; ইমাম খাযেন,তাফসীরে খাযেন, দারুল ফিকর বৈরুত, ১৩৯৯ হিজরী, খ: ৬, পৃ: ১৪৩; ইমাম বগভী,তাফসীবে বগভী, দারু তাইয়িবাহ লিন- নশর ওয়াত্ তাওযীহ, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪১৭ হিজরী, খ: ৭, পৃ: ২২৮) হযরত ইবন আব্বাস,হযরত কাতাদাহ্,হযরত ইবন জুবাইর,হযরত মুজাহিদ,হযরত যাইদ,হযরত হাসান বসরি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমসহ জমহুর উলামায়ে কিরামের মতে এ আয়াত লাইলাতুল কদর সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।(ইমাম আলূসি,রুহুল মায়ানি,দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ্,বৈরুত,১ম সংস্করণ,১৪১৫হি,খ.১৩,পৃ.১১০;ইমাম কুরতুবি,প্রাগুক্ত) এটিই অধিকতর নির্ভরযোগ্য বর্ণনা।
সুন্নাহর আলোকেঃ- ‘শবে বরাত’ উদ্যাপন ও তাৎপর্য সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস শরিফ বর্ণিত রয়েছে। তন্মধ্য থেকে কয়েকটি উল্লেখ করা হল।
হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন শা’বান মাসের পনের তারিখ উপনীত হলে তোমরা ইবাদতের মাধ্যমে রাত উদ্যাপন কর এবং দিনে রোযা রাখ। কেননা, মহান রাব্বুল আলামীন সূর্য অস্তমিত হবার পর প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়ে বলেন, ক্ষমা প্রার্থনা করার কে আছে, যাকে আমি ক্ষমা করব? রিযিক প্রার্থনা করার কে আছে, যাকে আমি রিযিক প্রদান করব? কে বিপদগ্রস্ত আছে, যাকে আমি বিপদ মুক্ত করব? এভাবে ফজর পর্যন্ত বিভিন্ন কিছু প্রার্থনার জন্য আহ্বান করতে থাকবেন।”(ইমাম ইবনু মাজাহ, আস্ সুনান, দারুল ফিকর, বৈরুত, খ: ১ম, পৃ: ৪৪৪; কাযী শাওকানী, তুহফাতুজ জাকেরীন, দারুল ক্বলস, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৪ইং, খ: ১ম, পৃ: ২১৭;ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, মাকতাবাতুর রুশদ, ১ম সংস্করণ, ১২১৩ হিজরী, খ: ৫ম, পৃ: ৩৫৪)
উল্লেখ্য, হাদিস শরিফে বর্ণিত “আল্লাহ তায়ালা প্রথম আকাশে অবতরণ করেন” এর মর্মার্থ হচ্ছে শবে বরাতের রাতে আল্লাহ তায়ালা আপন বান্দাদেরকে অতীব নৈকট্য প্রদান করেন।( মুল্লা আলি কারি,মিরকাত,দারুল ফিকর,বৈরুত,১ম সংস্করণ,১৪২২হি,খ.৩,পৃ.৯৬৯;আল্লামা সনদি,হাশিয়া আলা সুনানু ইবনে মাজাহ্,প্রকাশনা ও তাং অনুল্লিখিত,খ.৩,পৃ.১৫৭; আল্লামা সনদি,হাশিয়া আলা সুনানু ইবনে মাজাহ্, প্রকাশনা ও তাং অনুল্লিখিত,খ.৩,পৃ.১৫৭)
বাক্যটি রূপাকার্থে প্রয়োগ হয়েছে। যেমন আমাদের সমাজে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। “কেউ যদি আমার জন্য এক হাঁটু পানিতে নামে,আমি তার জন্য একগলা পানিতে নামি।এর উদ্দেশ্য হচ্ছে -সামান্য কিছুর বিনিময়ে অধিক প্রতিদান দেয়া। কারণ আল্লাহ তায়ালা উঠা-নামা,স্থান-কাল ইত্যাদি অবস্থা থেকে পবিত্র।( ইমাম তাফতাযানি,শরহুল মাকাসিদ,দারুল মায়ারিফুন নুমানিয়্যাহ,পাকিস্থান,প্র.১৪০১ হি.,খ.২,পৃ.২৭০)
হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন
“আমি এক রাত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ঘরে পাইনি। অতঃপর আমি ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁকে জান্নাতুল বক্বীতে পেয়েছি। তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি ভয় কর যে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার উপর অন্যায় করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! মূলত তা-ই নয়; বরং আমি মনে করেছি যে আপনি আপনার কোন স্ত্রীর নিকট এসেছেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত কুদরতিভাবে প্রথম আসমানে আসেন আর ‘কাল্ব’ নামক গোত্রের ছাগলের সমুদয় পশমের চেয়েও বেশি সংখ্যক ব্যক্তিদেরকে ক্ষমা করে দেন।”(ইমাম তিরমিযী, আল-জামেঈ আস-সহীহ, দারু, ইহইয়ায়িত্ তুরাসিল আরবি, বৈরুত, খ. ৩য়, পৃ. ১১৬; ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, মুসনাদ, আলামুল কুতুব, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪১৯ হিজরী, খ. ৬, পৃ. ২৩৮;বদরুদ্দীন আইনী, উমদাতুল ক্বারী, তারিখ বিহীন, খ. ১৭, পৃ: ৪৯; ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান; দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪১০ হিজরী, খ. ৩য়, পৃ. ৩৭৯)
রাসূলুল্লাহর এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী বলেন“কল্ব গোত্রের ছাগল সবচেয়ে বেশি হবার কারণে তিনি এ গোত্রের ছাগলের কথা উল্লেখ করেছেন।” মূলত সংখ্যা নয়; বরং আধিক্য বোঝানোই উদ্দেশ্য। উল্লিখিত হাদিস শরিফ দ্বারা বোঝা গেল যে, ‘লাইলাতুল বরাত’ রাসূলের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। (.মোল্লা আলী ক্বারী, প্রাগুক্ত,খ.৩য়,পৃ.৯৬৮)
লাইলাতুল বরাতের নামকরণ : ‘লাইলাতুল বরাতের’ বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে। এটি বিভিন্ন কিতাবে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন হাদিস শরিফে এটি ‘লাইলাতুন নিস্ফ মিন শা’বান’ নামে এসেছে। মুহাদ্দিসিনে কিরাম, মুফাস্সিরিনে ইজাম এবং ফুকাহায়ে কিরামসহ অন্যান্যদের নিকট বিভিন্ন নামে পরিচিত। আবার স্থানভেদে এর পরিচিতির ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন উপমহাদেশে এটি ‘শবে বরাত’ নামে অধিক পরিচিত। তবে ‘লাইলাতুল বরাত’ নামটিও অধিকাংশ মানুষ জানে। ‘লাইলাতুল বরাতের’ কতিপয় নাম হলÑ(১) ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ তথা বরকতময় রাত; কেননা এতে নেককারদের ওপর অধিক পরিমাণে বরকত অবতীর্ণ হয়। এ বরকত ‘আরশ’ থেকে ‘তাহ্তাস্ সারা’ পর্যন্ত পৌঁছে (২) ‘লাইলাতুর রহমত’ বা রহমতের রাত; কেননা এ রাতে আল্লাহ্র বিশেষ রহমত অবতীর্ণ হয় (৩) ‘লাইলাতুল বরাত’ বা মুক্তির রাত; কেননা এ রাতে মুমিন ব্যক্তির মুক্তি লেখা হয় এবং অসংখ্য জাহান্নামীদের মুক্তি দেয়া হয়। (৫) লাইলাতুল ক্বিস্মাহ ওয়াত্-তাক্বদীর বা বন্টনের রাত; কেননা, এ রাতে মানুষের রিযিক বণ্টন করা হয় (৬) ‘লাইলাতুর তাগফীর’ বা ক্ষমার রাত। ইমাম সবুকী বলেন, এ রাতে অপরাধীদের অপরাধ ক্ষমা করা হয় (৭) ‘লাইলাতুল ইজাবা’ বা দোয়া কবুলের রাত, কেননা এ রাতে দোয়া কবুল হয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন, এ রাতটি দোয়া কবুল হয় এমন পাঁচ রাতের একটি (৮) ‘লাইলাতুল হায়াত’ বা হায়াতের রাত। (৯) ‘লাইলাতু ঈদিল মালায়িকা’ বা ফেরেশতাদের খুশির রাত; কেননা এটি ফেরেশতাদের দুটি ঈদের একটি (১০) ‘লাইলাতুত্-তাজীম’ বা সম্মানিত রাত (১১) ‘লাইলাতুল গুফরান ওয়াল ইতকি মিনাল নিরান’ বা ক্ষমা করার রাত এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত (১২) ‘লাইলাতুল ক্বদর’ বা নির্ধারণের রাত; কেননা এ রাতে মানুষের হায়াত-মৃত্যু ও রিযিক নির্ধারণ করা হয় (১৩) ‘লাইলাতুস্ সক্’ বা দফতর লিপিবদ্ধের রাত। কেননা এ রাতে আমলের দফতর লিপিবদ্ধ করা হয়। (১৪) ‘শবে বরাত’ বা মুক্তির রাত। এটি উপমহাদেশে প্রচলিত।( শাইখ সালিম সনহুরী, ফাদায়িলু লাইলাতি নিস্ফি শাহরি শাবান, পৃ: ২-৪; আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী, প্রাগুক্ত, খ. ২য়, প. ৪১৬)
লাইলাতুল বরাত উদ্যাপনঃ
‘লাইলাতুল বরাতের রাতটি তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ার কারণে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ইবাদতের মাধ্যমে এ রাত উদ্যাপন করেছেন। যেমন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন-
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতে নামায পড়ছিলেন এবং সিজদায় দীর্ঘ অবস্থানের কারণে আমি মনে করলাম যে, তিনি ইনতেকাল করেছেন। তাঁর অবস্থা জানার জন্য আমি তাঁকে নাড়া দিলে তিনি নড়ে উঠেন এবং আমি তাঁকে সিজদায় বলতে শুনেছি “হে আল্লাহ্, আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে আপনার শাস্তি থেকে পানাহ চাই, আপনার সন্তুষ্টির মাধ্যমে আপনার রাগ থেকে আশ্রয় চাই আর আপনার যথাযথ প্রশংসা আমি করতে পারব না; এজন্য আমি আপনার সেই প্রশংসা করছি, যা আপনি আপনার জন্য করেছেন। এরপর সিজদাহ থেকে মাথা উত্তোলন করেছেন। অতঃপর নামায শেষ করে আমাকে বললেন, হে আয়েশা, আল্লাহ্র রাসূল কি তোমার সাথে কোন ধরণের খিয়ানত করেছেন? আমি বললাম, আল্লাহ্র শপথ করে বলছি, এ ধরণের কোন কিছু নয়; বরং সিজদায় আপনাকে দীর্ঘকাল অবস্থানের কারণে আমি মনে করেছি যে, আপনি ইনতেকাল করেছেন। এ কথা শুনে তিনি বললেন, তুমি কি জান না এটি বরাতের রাত ? আমি বললাম, আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল ভাল জানেন। এরপর তিনি বললেন, আজ ‘শাবান মাসের পনের তারিখ। এ রাতে মহান রাব্বুল আলামীন ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন। রহমত প্রার্থনাকারীদের রহমত প্রদান করেন এবং বিদ্বেষীদের অবকাশ দেন।”(ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, প্রাগুক্ত, ঘ: ৫ম, পৃ: ৩৬১;আব্দুল আজীম আল-মুনাভী, আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব, দারুল কুতুব আল-ইলমিয্যাহ, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪১৭ হি:, খ:২,পৃ:৭৪ ;আব্দুর রহমান মুবারক পুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, খ: ৩, পৃ: ৩৬৬)
হযরত মুয়ায বিন জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন,
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি চন্দ্র বছরের পাঁচটি রাত তথা শাবান মাসের পনের তারিখের রাত, ঈদুল ফিতরের রাত, ঈদুল আযহার রাত, আরাফার রাত এবং জিলহাজ্ব মাসের আট তারিখ রাত উদ্যাপন করবে, সেই জান্নাতের হক্বদার হবে যাবে।”(আব্দুল আজীম আল-মুনাভী,প্রাগুক্ত,খ:২,পৃ:৯৮; আলা উদ্দিন মুত্তাকী আল হিন্দী, কানযুল উম্মাল, মুয়াস্ সাসাতুর, রিসালাহ, ৫ম সংস্করণ, ১৪০৮ হিজরী, খ. ৮, পৃ: ৪৪৮)
হযরত কাসীর বিন দীনার থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
“যে ব্যক্তি সওয়াবের নিয়তে শা’বান মাসের ১৫ তারিখের রাত তথা লাইলাতুল বরাত এবং দুই ঈদের দুই রাত উদ্যাপন করবে, তাঁর অন্তর মরার দিনেও মরবে না।”(ইবনু নুজাইম,আল-বাহরুর রায়েক্ব, কিতাবুস সালাত, দারু ইহইয়ায়িত্ তুরাসিল আরবি,বৈরুত,খ.৪র্থ,পৃ. ১৪৬-১৪৭; আব্দুল আজীম আল-মুনাভী,প্রাগুক্ত,খ.২,পৃ:৯৮)
এভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এই রাত উদ্যাপন করে স্বীয় উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা এ রাতে নামায আদায় কর, আল্লাহ্কে স্মরণ কর এবং দিনে রোযা রাখ।
উল্লিখিত হাদিসের বর্ণনা থেকে বোঝা গেল যে, ‘শবে বরাত’ ইবাদতের মাধ্যমে উদ্যাপনের প্রমাণ
রাসূলুল্লাহ থেকে পাওয়া যায় এবং এটি নব প্রচলিত কোন কিছু নয়।
‘লাইলাতুল বরাত’ উদ্যাপনে ফোকাহায়ে কিরামের অভিমতঃ-
ইবাদতের মাধ্যমে লাইলাতুল বরাত উদ্যাপনে ফোকাহায়ে কিরামের অভিমত নিয়ে উল্লেখ করা হল।
ফকীহগণের অভিমতঃ-
১. প্রখ্যাত ফকীহ ইবনু নুজাইম হানাফী আলাইহির রাহমাহ বলেন-
“শা’বান মাসের পনের তারিখ,যিল হজ্জের দশ তারিখ,দু’ঈদের দু’রাত এবং রমজান মাসের শেষ দশ রাত রাত জেগে ইবাদত করা মুস্তাহাব। কেননা এ ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত রয়েছে। আল্লামা আব্দুল আজীম আল-মুনাভী স্বীয় কিতাব ‘আত্-তারগিব ওয়াত তারহিব’গ্রন্থে এ সকল হাদিস শরিফ বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। এখানে ‘উদযাপন করা’ অর্থ হলো সারা রাত জেগে ইবাদত করা।” (ইবনু নুজাইম,আল-বাহরুর রায়েক্ব, কিতাবুস সালাত, দারু ইহইয়ায়িত্ তুরাসিল আরবি,বৈরুত,খ:৪র্থ,পৃ: ১৪৬-১৪৭)
২. প্রখ্যাত ফকীহ আল্লামা ইবন আবেদীন শামী বলেন,
“নির্দিষ্ট সংখ্যার হিসাব না করে একাকি নফল নামায আদায় করা, কুরআন-হাদিস পাঠ ও শ্রবণ করা, তাসবিহ,আল্লাহর প্রশংসা এবং নবীর ওপর দরূদ শরিফ পাঠের মাধ্যমে লাইলাতুল বরাত উদ্যাপন করা হয়ে থাকে।”(ইবন আবেদীন শামী, রাদ্দুল মুহতার, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৪২১ হিজরী, খ. ২য়, পৃ: ২৬)
৩. ইমাম হাসান শুরুনবুলালি আলাইহির রাহমাহ বলেন-
“লাইলাতুল বরাত উদ্যাপন করা মুস্তাহাব। কেননা এ রাত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং এ রাতে রিযিক বন্টন করা হয় আর মৃত্যু নির্ধারণ করা হয়।”(ইমাম হাসান শুরুনবুলালি, মারাকিল ফালাহ,আল-মাকতাবাতুল আসরিয়্যাহ,বৈরুত, ১৪২৫হি,খ.১,পৃ.৭৩)
৪.ইমাম শাফিঈ আলাইহির রাহমাহ বলেন-
“বছরের পাঁচটি রাতে দোয়া কবুল হয়। এগুলো হল শুক্রবারের রাত(বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত), দুই ঈদের দুই রাত, রজব মাসের প্রথম রাত এবং শাবান মাসের পনের তারিখের রাত। এ রাতগুলো সম্পর্কে আমি যা বর্ণনা করেছি, তা আমি পছন্দ করি।”(ইমাম শাফি,কিতাবুল উম,দারুল ফিকর,বৈরুত,১ম সংস্করণ,১৪০০হি,খ.১ম,পৃ.২৬৪;ইবন রজব হাম্বলি,লাতায়িফুল মায়ারিফ,দারু ইবন হাজম,বৈরুত,১ম সংস্করণ,১৪২৪হি,পৃ.১৩৭)
৫. ফকীহ মনসুর বিন ইউনুস বুহুতী হাম্বলী বলেন-
اسْتِحْبَابِ قِيَامِهَا) أَيْ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ)
“শাবান মাসের পনের তারিখ কিয়ামুল লাইল তথা ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপন করা মুস্তাহাব।”(ইমাম বহুতী, কাশফুল ক্বিনা, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৪০২ হি:, খ. ১ম, পৃ. ২)
৬. আল্লামা রুহায়বানী হাম্বলী বলেন,
اسْتِحْبَابُ قِيَامِهَا كَلَيْلَةِ الْعِيدِ
“শাবান মাসের পনের তারিখ রাত ঈদের রাতের মত কিয়ামুল লাইল তথা ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপন করা মুস্তাহাব।”(রুহায়বানী, মাতালিবু উলির নেহী, আলমাকতাবাতুল ইসলামী, দামেস্ক, ১৯৬১ ইং, খ: ১ম, পৃ: ৫৮১)
৭. গাউসুল আজম আব্দুল কাদের জিলানি হাম্বলী আলাইহির রাহমাহ বলেন-
“কতিপয় আলেম ওই চৌদ্দটি রাতকে একত্রে করে লিখেছেন,যেগুলোকে ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপন করা মুস্তাহাব। তিনি বলেন- এ রাতগুলোর সংখ্যা হচ্ছে বছরে চৌদ্দটি। এগুলো হল-১.মুর্হারাম মাসের ১ম রাত ২.আশুরার রাত(মুহাররাম মাসের ১০ম রাত) ৩.রজব মাসের ১ম রাত ৪.রজব মাসের ১৫ তারিখের রাত ৫.রজব মাসের ২৭ তারিখের রাত(শবে মি’রাজ) ৬.শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত তথা শবে বরাত ৭.আরাফাতের রাত(৯ যিলহজ্ব’র রাত) ৮.ঈদুল ফিতরের রাত ৯.ঈদুল আযহার রাত ১০-১৪.রমজান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় পাঁচ রাত।”(ইমাম আব্দুল কাদের জিলানি,গুনইয়াতুত তালেবিন(আল-গুনইয়াতু লিতালিবি তরিক্বিল হক্ব,দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ,বৈরুত,১মসংস্করণ,১৪১৭হি.,খ.১,পৃ.৩২৮)
৮. ইবন রজব হাম্বলীর মতেও এ রাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব। এ রাতে রাসূলুল্লাহ্ পরিপূর্ণ রাত ইবাদত করতেন।( ইবনু রজব হাম্বলি,প্রাগুক্ত,পৃ.১৩৮)
৯.আল্লামা ইবনুল হাজ্ব মালেকী বলেন-
“শাবান মাসের পনের তারিখের রাতটি যদিও লাইলাতুল কদর নয়, তথাপি অত্যাধিক সম্মানিত ও বরকতময়। সলফে সালেহীনরা এ রাতকে খুব সম্মান করতেন এবং এ রাত আগমণ করার পূর্বে এর
জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। আগমনের পর শরিয়ত সমর্থিত বিষয়ের মাধ্যমে এর সম্মান করতেন।”(ইবনুল হাজ্ব মালেকী, আল-মাদহাল, দারুল ফিকর,১৪০১ হিজরী, খ: ১ম, পৃ: ২৯৯)
১০.মিশর দারুল ইফতার ফতোয়া ঃ ‘লাইলাতুল বরাত সম্পর্কে মিশর দারুল ইফতার ফতোয়াটি সুদীর্ঘ যার মূল বক্তব্য উল্লেখ করা হল। লাইলাতুল বরাত সম্পর্কে তথা এর গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক হাদিস রয়েছে যার মধ্যে কিছু হল সহিহ আর কিছু যয়ীফ। উলামাগণ ‘যয়ীফ হাদিস’ এর উপর আমল করার বৈধতা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাইলাতুল বরাতে নামায পড়তেন; কিন্তু তাঁর রাত্রি জাগরণের বিষয়টি নজরে না পড়ার কারণ হল তিনি প্রায় রাত জেগে নামায পড়তেন। তাঁর লাইলাতুল বরাত পালনটি ছিল ব্যক্তিগত, সম্মিলিতভাবে নয়। বর্তমানে যেভাবে সবাই সম্মিলিতভাবে এ রাত উদ্যাপন করে, তা তাঁর যুগে এবং সাহাবায়ে কিরামের যুগে ছিল না; তবে এটি তাবেয়ীনদের যুগে শুরু হয়েছিল। এ রাত ইবাদতের মাধ্যমে উদ্যাপন করার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই; তবে মসজিদে সম্মিলিতভাবে পড়বে, না-কি ঘরে একাকী পড়বে এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এ মতবিরোধের যে কোন একটি অভিমতের উপর আমল করা যাবে। অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে মসজিদেও নামায পড়া যাবে অথবা একাকী ঘরেও নামায পড়া যাবে।( ফাতায়ায়ে দারুল ইফতা আল মিসরিয়্যাহ, ওযারাতুল আওকাফিল মিসরিয়্যাহ, মিশর, ১৯৯৭ইং, খ: ১০ম, পৃ: ১৩১)
১১.কুয়েত সরকারের ফতোয়া :
‘কুয়েত সরকারের ওয়াক্ফ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বিশ্বকোষ তথা ইসলামিক বিশ্বকোষে রয়েছে-
“শাবান মাসের পনের তারিখ রাত উদ্যাপন করার ক্ষেত্রে সকল ফকীহ একমত। তাঁদের মতে এ রাত উদ্যাপন করা মুস্তাহাব। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন , এ রাতে তোমরা কিয়ামুল লাইল তথা ইবাদতের মাধ্যমে আর দিনে রোযা রাখার মাধ্যমে পালন কর।”(সম্পাদনা পরিষদ,আল-মুসুয়াত ফিকহিয়্যাহ আল-কুয়েতিয়্যাহ, ওয়ারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুয়ুনুল ইসলামী, কুয়েত, ২য় সংস্করণ, ১৪০৪ হি:, খ. ২য়, প. ২৩৫)
১২.দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া : “এ রাত অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ। এ রাতে একাকী নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা, যিকির করা, কবর যিয়ারত করা, দোয়া এবং ক্ষমা চাওয়া মুস্তাহাব। তবে সম্মিলিতভাবে মসজিদে নয়।”(ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ,ভারত,খ.১,পৃ.১০২ ও ২৯৩)
তারা মূলত দিতীয় অভিমতের উপর ফতোয়া দিয়েছেন ।
১৩.দেওবন্দ গুরু আশরাফ আলী থানভী বলেন, ‘১৫ শাবান রাত জেগে ইবাদত করা উত্তম; প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক।’(মাওলানা আখতারুজ্জমান,লাইলাতুম মুবারাকাহ্,আজিমপুর দায়রা শরিখ খানকা,ঢাকা,২য় সংস্করণ,২০০৭ইং,পৃ,৫২)
১৪. আব্দুল হাই লাকনভী বলেন-
“লাইলাতুল বরাতে জাগ্রত থেকে ইবাদতে মশগুল থাকার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। এ ব্যাপারে ইমাম ইবন মাজাহ এবং ইমাম বায়হাকি হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেন,রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন-“শা’বান মাসের পনের তারিখ উপনীত হলে তোমরা ইবাদতের মাধ্যমে রাত উদ্যাপন কর এবং দিনে রোযা রাখ। কেননা, মহান রাব্বুল আলামীন সূর্য অস্তমিত হবার পর প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়ে বলেন, ক্ষমা প্রার্থনা করার কে আছে, যাকে আমি ক্ষমা করব? রিযিক প্রার্থনা করার কে আছে, যাকে আমি রিযিক প্রদান করব? কে বিপদগ্রস্ত আছে, যাকে আমি বিপদ মুক্ত করব? এভাবে ফজর পর্যন্ত বিভিন্ন কিছু প্রার্থনার জন্য আহ্বান করতে থাকবেন।”...উল্লিখিত বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই রাতে অধিক ইবাদত,দুয়া,কবর যিয়ারত এবং মৃতদের জন্য দুয়া করতেন। সকল প্রকার হাদিসে কাওলি এবং হাদিসে ফে’লি দ্বারা ঐ রাতে অধিক পরিমাণে ইবাদত করা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়েছে। নামায বা অন্য ইবাদত করার ব্যাপারে সে স্বাধীন। যদি নামায পড়াকে সে গুরুত্ব দেয়, তাহলে সে যত রাকাত ইচ্ছা পড়তে পারবে। যে বিষয় নিষেধ হবার ব্যাপারে রাসূলের কোন নির্দেশ সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতে রয়েছে, তা অবশ্য বর্জনীয়।”(আব্দুল হাই লকনবী, আল-আছারুল মারফুয়াহ, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, খ. ১ম পৃ: ৮১-৮২)
১৫. লামাযহাবীদের নির্ভরযোগ্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ইবনে তাইমিয়া হাম্বলী বলেন-
“শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের ফযিলত সম্পর্কে অসংখ্য শুদ্ধ হাদিস রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে এ রাতের মর্যাদা বোঝা যায়। সলফে সালেহীনগণ এ রাতে নামাজ পড়ার জন্য নির্ধারণ করে রাখতেন এবং দিনে রোজা রাখতেন। কেননা এ ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদিস রয়েছে। পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের কিছু আলেম এ রাতের মর্যাদাকে অস্বীকার করেছে এবং সহীহ হাদিসের ওপর অপবাদ দিয়েছে। কিন্তু আমাদের হাম্বলী মাযহাবসহ অন্যান্য মাযহাবের অধিকাংশ আলেমদের মতে এ রাতটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল এর মতও এটি। কেননা এ ব্যাপারে অসংখ্য হাদিস শরিফ রয়েছে।”(ইমাম ইবন তাইমিয়া,ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম,দারু আলামিন কুতুব,বৈরুত,৭ম সংস্করণ,১৪১৯হি,খ.২,পৃ.৯৭)
১৬. গায়রে মুকাল্লিদিন’র প্রখ্যাত আলেম শায়খ আব্দুর রহমান মুবারকপুরী শবে বরাত উদযাপনের পক্ষে একাধিক হাদিস উল্লেখ করে বলেন-এ সকল হাদিস তাদের জন্য প্রমাণ,যারা মনে করে যে, শবে বরাতের কোন ফযিলত প্রমাণিত নয়।”(শায়খ মুবারকপুরী,তুহফাতুল আহওয়াযি,দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ,বৈরুত,খ.৩,পৃ.৩৬৭)
১৬.লামাযাহাবিদের অতি প্রিয় ও নির্ভযোগ্য ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানি স্বীয় কিতাব “সিলসিলাতুল আহাদীসিল সহিহা” গ্রন্থে লাইলাতুল বরাত সম্পর্কিত অনেক হাদিস উল্লেখ করত: এগুলোর মান যাচাই করার পর বলেন-
“সার কথা হল (হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা থেকে বর্ণিত উপরিউক্ত) হাদিস শরিফটি (বর্ণিত) সকল সূত্রের সমন্বয়ে নি:সন্দেহে সহিহ। হাদিস অতিশয় দুর্বল না হলে আরো কম সংখ্যাক সূত্রে বর্ণিত হাদিস দ্বারা হাদিসের বিশুদ্ধতা প্রমাাণিত হয় তথা কোন দুর্বল হাদিসও অন্য সূত্রের কারণে সহিহ হয়ে যায় যেমন এ হাদিসে(শবে বরাত বিষয়ে হযরত আয়েশ সিদ্দিকা রা: থেকে বর্ণিত ) হয়েছে। শাইখ কাসেমি তাঁর ‘ইসলাহুল মাসাজিদ’ গ্রন্থের ১০৭ পৃষ্ঠায় হাদিস বিশারদগণের উদ্ধৃতিতে লিখেছেন যে, ‘শবে বরাতের ফযিলত সম্পর্কে কোন সহিহ হাদিস নেই।’ তাঁর এ কথার ওপর আস্থা রাখা উচিত নয়। আর যদি তাঁদের থেকে কেউ এ কথা বলেও ফেলে,তাহলে বুঝতে হবে যে,চিন্তা-ভাবনা ছাড়া অতি তাড়াহুড়া হেতু এবং বর্তমান পদ্ধতির ন্যায় হাদিসের বিভিন্ন সূত্র অন্বেষণের প্রচেষ্টা সীমিত হবার কারণেই এমনটা হয়েছে। মহান আল্লাহই তাওফিকদাতা।”(নাসিরুদ্দিন আলবানি,‘সিলসিলাতুল আহাদীসিল সহিহা’,দারুল মায়ারিফ,রিয়াদ,খ.৩,পৃ.২১৮)
উল্লিখিত বর্ণনা থেকে বোঝা গেল, লাইলাতুল বরাত উদ্যাপন করার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই; তবে এ রাতে নামাযের পদ্ধতি দিয়ে তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন, সম্মিলিতভাবে মসজিদে নামায পড়া মাকরুহ, আর কেউ কেউ বলেন, সম্মিলিতভাবে মসজিদে নামায পড়া মুস্তাহাব। এ মতপার্থক্য সমাধানে ‘ফতোয়ায়ে আযহার’ এ উল্লেখ আছে, ‘যেহেতু এ মতপার্থক্য তাবেয়ীনদের মধ্যে হয়েছে, সেহেতু যে কোন একটি মতের ওপর আমল করা যাবে।’
এ রাতের তাৎপর্যঃ- লাইলাতুল বরাতের তাৎপর্য বর্ণনাতীত, যা হাদিস শরিফ দ্বারা প্রমাণিত। তন্মধ্যে কতিপয় তাৎপর্য উল্লেখ করা হল।
হযরত রাশেদ বিন সাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় মহান রাব্বুল আলামীন লাইলাতুল বরাতে বান্দার নিকটে আসেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন। সেই বছর আল্লাহ তায়ালা যাদের মৃত্যুদানে ইচ্ছুক, তাদের সম্পর্কে তিনি হযরত আজরাইল আলাইহিস সালামকে অবহিত করেন। ”(আহমদ দীনাওয়ারী মালেকী, আল-মুজালাসাহ্ ওয়া জাওয়াহিরুল ইলম, দারু ইবনি হাযয, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪২৩ হিজরী, খ. ১ম, পৃ: ২০৬)
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ্ জিজ্ঞেস করলেন-
“হে আয়েশা, আজ কোন রাত তুমি জান? না, ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন, আজ শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত, এ রাতে লিপিবদ্ধ করা হয় তাঁদের নাম, যারা এ বছর জন্মগ্রহণ করবে, যারা মারা যাবে এবং এ রাতে তাদের আমল আল্লাহ্র নিকট নেয়া হয় আর তাদের রিযিক অবতীর্ণ করা হয়। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল, কোন ব্যক্তি কি আল্লাহ্র রহমত ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করবে? তিনি বললেন, আল্লাহ্র রহমত ব্যতীত কোন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না ? অতঃপর আমি বললাম, আপনিও? তিনি বললেন, আমিও নই; তবে আল্লাহ্ আমাকে তাঁর রহমত দ্বারা বেষ্টন করে নিয়েছেন। তিনি এ বাক্য তিনবার বলেছেন।”(ইমাম বায়হাকী, আদ্ দাওয়াতুল কবীর, গিরাস লিন-নশর ওয়াত তাওযীহ, ১ম সংস্করণ, ২০০৯ইং, খ. ২, পৃ. ১৪৬)
হযরত কাব রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত।তিনি বলেন-
“মহান রাব্বুল আলামীন শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে জিবরাইলকে ডেকে নির্দেশ দেন যে, তুমি গিয়ে জান্নাত সজ্জিত কর; কেননা আজ রাত আমি আসমানের তারাসম,পৃথিবীর সকল রাত-দিনের সমান সংখ্যক ও সকল গাছের পাতা এবং পাহাড়ের ধুলিকণাসম ব্যক্তিদের ক্ষমা করব।”(ইবন রজব হাম্বলি,প্রাগুক্ত,পৃ.১৩৮;আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি,মাসাবাতা বিস- সুন্নাহ, ইতিকাদ পাবলিকেশন হাউস, দিল্লী, পৃ.১৯৬)
হযরত আত্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা বলেন-
“শাবান মাসের পনের তারিখ রাত আল্লাহ্ তায়ালা হযরত আজরাইল আলাইহিস সালামকে একটি দফতর প্রদান করে বলেন, এখানে যাদের নাম রয়েছে, তাদের জান কবজ করবে। আমার কোন বান্দা গাছ রোপণ করেছে, আর কেউ বিবাহ করছে আর কেউ প্রাসাদ তৈরীতে ব্যস্ত রয়েছে; অথচ তার নাম মৃত্যুর দফতরে উঠে গেছে।”(সাইয়িদ মুহাম্মদ যকী ইব্রাহীম, লাইলাতুন নিসফ মিন শাবান, ৭ম সংস্করণ, পৃ: ১৩ ; ইমাম গাজ্জালী, ইয়াহ্ ইয়উ উলূমিন দীন, দারুল ফিকর, বৈরুত, খ. ৪র্থ, পৃ: ৪৬৮;শায়ইখ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী, প্রাগুক্ত, পৃ: ১৯৬-১৯৭)
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-
“একদিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে বললেন, হে আয়েশাÑ প্রতি বছর এমন কোন প্রাণী মরবে না, যার মৃত্যুর তারিখ শাবান মাসে লিখা হয়নি। আর আমি পছন্দ করি আমার ইনতিকালের তারিখ যেন এমন অবস্থায় লিখা হোক, যখন আমি সৎকাজ এবং আমার প্রভুর ইবাদতে মশশুল থাকি।”(সাইয়েদ যকী ইব্রাহীম, প্রাগুক্ত পৃ: ১৩;খতিব আল-বাগদাদি,তারিখু বাগদাদ,দারুল গারবিল ইসলামি,বৈরুত,খ.৬,পৃ.১২৬)
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন-
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, চারটি রাতে আল্লাহ্ রহমতের দরজা খুলে দেন। এগুলো হল ঃ ঈদুল ফিতরের রাত, ঈদুল আযহার রাত, শাবান মাসের পনের তারিখের রাত এবং আরাফার রাত। ১৫ শাবান রাতে মৃত্যু নির্ধারণ, রিযিক বন্টন আর হাজীদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়।”(ইবনুজ যাওজী, আত্-তাবছিরাহ, প্রকাশনা ও তারিখ বিহীন, খ: ২, পৃ: ৪৯; জালাল উদ্দিন সূয়তী, জামেউল আহাদীস, প্রকাশনা ও তারিখ বিহীন, খ. ২৪, পৃ: ২৬৬, হাদীস নং: ২৭১২২)
উল্লিখিত বর্ণনা থেকে বোঝা গেল যে, লাইলাতুল বরাতে আল্লাহ্র বিশেষ রহমত অবতীর্ণ হয়, বান্দার রিযিক বন্টন করা হয়, মৃত্যুর সময় লিপিবদ্ধ করা। অগণিত পাপীদের ক্ষমা করা হয়। তাই এ রাতে জেগে থেকে ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লাইলাতুল বরাতের আমলঃ-
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
“যে ব্যক্তি শাবানের পনের তারিখ রাত এবং দুই ঈদের দুই রাত উদ্যাপন করবে, তাঁর অন্তর মৃত্যুর সময়েও মরবে না এবং সে জান্নাতের উপযোগী হয়ে যাবে।’(ইবনুজ জাওযী, আত্ তাবছিরাহ, প্রাগুক্ত, খ. ২য়, পৃ: ৫০)
এ রাত উদ্যাপনে কী কী কাজ করা যায়, তার ব্যাখ্যায় ‘মারাক্বীল ফালাহ’ গ্রন্থকার হাসান শুরুন বুলালী, ইমাম তাহত্বাভী, ফিকহুল ইবাদাত গ্রন্থকার আল্লামা আল-হাজাহ নাজাহ আল-হালাভী, ইবনু রজব হাম্বলী প্রমুখ ফকীহগণ বলেন, “লাইলাতুল বরাত উদ্যাপন বলতে সম্পূর্ণ বা অধিক রাত পর্যন্ত জেগে কোন ইবাদতে মশগুল থাকা যেমন নামাজ পড়া বা কুরআন তিলাওয়াত করা বা কুরআন পাঠ শোনা বা হাদিস শরিফ পাঠ করা বা তাসবীহ পড়া বা যিকির করা বা দরূদ শরিফ পাঠ করা।”(হাসান শুরুন বুলালী, প্রাগুক্ত, খ: ১ম, পৃ: ১৯৩-১৯৪ , ইমাম তাহত্বাভী, হাশিয়া আল মারাক্বিল ফালাহ, প্রাগুক্ত, খ. ১ম, পৃ: ৭০ ,
ইবনু রজব হাম্বলী, লাত্বায়িফুল মায়ারিফ, প্রাগুক্ত, খ. ১ম পৃ: ১৩৮ , আল হাজাহ নাজাহ আল-হালাভী, ফিকহুল ইবাদাত, প্রকাশনা ওতারিখ বিহীন, খ. ১ম, পৃ: ১০৭)
এ রাতের উল্লেখযোগ্য কতিপয় আমলের বিবরণ সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে উল্লেখ করা হল।
(ক) নামায : নামায নিঃসন্দেহে একটি শ্রেষ্ঠ ইবাদত। উত্তম সময়ে পড়ার কারণে এটির সওয়াব ও মর্যাদা আরো দ্বিগুণ হয় যেমন কোন সরকারি কর্মচারীর বেতন বিশেষ দিনের কারণে দ্বিগুণ হয়। অসংখ্য সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ রাতে নামায পড়তেন এবং তাঁর উম্মতকেও ইবাদতে মশগুল থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই সলফে সালেহীণগণ এ রাতে বিশেষ গুরুত্বের সাথে নামায পড়তেন। যেমন প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত খালিদ বিন মাদান, লুকমান বিন আমির, হযরত মকশুল, হযরত বিন রাহ্বিয়াহ্ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ রাত জেগে সম্মিলিতভাবে মসজিদে নামায আদায় করতেন এবং এভাবে নামায পড়া মুস্তাহাব বলতেন।( হাসান শুরুন বুলালী, প্রাগুক্ত, খ. ১ম, পৃ: ২৯৪; আল-মাওস আতুল ফিকহিয়াহ, প্রাগুক্ত, খ: ২য়, পৃ: ২৩৭;ফতোয়ায়ে আজহার, প্রাগুক্ত,খ. ২য় পৃ: ২৬০;আব্দুল ক মুহাদ্দিস দেহলভী, প্রাগুক্ত, পৃ: ২০২)
হযরত ওমর বিন আব্দুল আজিজ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নিজেও এ রাতে ইবাদত করতেন এবং অন্যকেও পড়ার নির্দেশ দিতেন যেমন তিনি বসবার গভর্নরের নিকট চিঠি দিয়ে নির্দেশ দিলেন যে, তারা যেন এ রাত বিশেষভাবে ইবাদত করে। তিনি এ রাতে নামায পড়াকালে সিজদাহ থেকে মাথা উত্তলন করে দেখতে পেলেন একটি সবুজ কাপড়ের টুকরো, যার থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়ে আসমানের সাথে মিলিত হয়েছে। এর মধ্যে লিখা ছিল ‘পরাক্রমশালী বাদশার পক্ষ থেকে এটি তাঁর বান্দার জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তি বার্তা।’(শাইখ ইসমাইল হক্কী, রুহুল বয়ান, দারু ইহইয়ায়িত তুরাসিল আরবি, বৈরুত, তারিখ বিহীন, খ: ৮ম, পৃ: ৩১১)
এ আমল নবী করিম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগ থেকে অদ্যাবধি হক্বপন্থীদের মধ্যে বিরাজমান রয়েছে, আর এক শ্রেণীর লোক দরজা বন্ধ করে ঘুমায়; অথচ নামাযের ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই।
সলফে সালেহীনগণ এ রাতে একটি বিশেষ নামায পড়তেন, যার বর্ণনা শাইখ আব্দুল কাদের জিলানী ‘গুনিয়াতুত্-তালেবীন’ গ্রন্থে, ইমাম গাজ্জালী; ইহ্ইয়াউ উলুমিদ্দীন’ গ্রন্থে, শাইখ আবু তালেব মক্কী’ ‘কুতুল কুলুব’ গ্রন্থে, ইবনু রজব হাম্বলী ‘লাত্বায়িফুল মায়ারিফ গ্রন্থে, শাইখ ইসমাইল হক্বী’ তাফসীরে রুহুল বয়ান’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এ নামাযের নাম ‘সালাতুল খাইর’ ও ‘সালাতুল আল-ফিয়্যাহ’। এ ‘সালাতুল খাইর’ হচ্ছে একশ রাকাত। এ নামায পড়ার নিয়ম হচ্ছে প্রতি রাকাতে দশবার করে সূরা ইখলাস পড়বে সূরা ফাতিহা পড়ার পর। দুই রাকাতের নিয়্যত করে পঞ্চাশ সালামে একশ রাকাত পূর্ণ করবে অথবা যদি কেউ ইচ্ছে করে, তাহলে প্রতি রাকাতে একশবার সূরা ইখলাছ পড়ে দশ রাকাত পড়বে।( আব্দুল কাদের জিলানী, গুনিয়া তুত্ তালেবীন, ইরশাদ ব্রাদার্স, নয়াদিল্লী, পৃ: ৩৪৮;ইসমাইল হক্বী, প্রাগুক্ত; ইমাম গাজ্জালী, প্রাগুক্ত, খ. ১ম পৃ: ২০৩ ; আবু তালিব মক্কী, কুতুল কুলুব, দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২য় সংস্কার, ১৪২৬ হি., ১ম, পৃ: ১১৪) সালাতুল খাইরের পদ্ধতিটি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত হবার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসীনে কিরামের যথেষ্ট সমালোচনা রয়েছে; তবে বুজুর্গদের আমল হিসেবে করা যেতে পারে।
(খ) দোয়া করা : কোন কিছু পাওয়ার সম্পর্কটা চাওয়ার সাথে অত্যন্ত নিবিড়। না চাইলে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। বান্দা আল্লাহ্র কাছে না চাইলে তিনি রাগ করেন; বরং চাইলে খুশি হন। কারণ আমরা তাঁরই প্রতি মুখাপেক্ষী। তিনি পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
(হে মাহবুব) আমার বান্দারা যখন আমার ব্যাপারে আপনার নিকট জিজ্ঞেস করে, তাহলে আপনি বলে দিন আমি নিকটে রয়েছি। যখন প্রার্থনাকারী আমার নিকট প্রার্থনা করে, আমি প্রার্থনায় সাড়া দেই। সুতরাং তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক, আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।” রাসূলুল্লাহ্ ইরশাদ করেছেন- اَلدُّعَاءُ مُخُّ اَلْعِبَادَةِ “দোয়া হচ্ছে ইবাদতের মগজ।”(ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান, দারুল গারবিল ইসলামী, বৈরুত, ১৯৯৮ ইং, খ.৫, পৃ.৩১৬) তাই তিনি বেশি বেশি দোয়া করতেন। দোয়ার শর্ত পূরণ করে দোয়া করা উত্তম। দোয়া করার পর আল্লাহ্র পক্ষ থেকে দ্রুত কোন সাড়া পাওয়া না গেলে অস্থির হবার প্রয়োজন নেই। কারণ দোয়া কখনো বিফল হয় না। প্রত্যেক দোয়াই আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন। আল্লাহ তায়ালা কারো দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল করেন আর কারো দোয়া বিলম্বে কবুল করেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
কোন মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দোয়া করলে, তা যদি কোন পাপের জন্য বা সম্পর্ক ছিন্নের জন্য না হয়, তাহলে তা আল্লাহ তায়ালা তিনভাবে কবুল করেন । হয়ত তিনি (অনতিবিলম্বে) তার দোয়ায় সাড়া দেন অথবা তাঁর থেকে কোন মন্দ পরিণতি দূর করে দেন বা তাঁর দোয়ার সমপরিমাণ প্রতিদান আল্লাহ জমা করে রাখবেন। সাবাহায়ে কিরাম ইরশাদ করেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা যদি অধিক পরিমাণে দোয়া করি, তাহলে ? তিনি ইরশাদ করেন, আল্লাহ (তোমাদের চাওয়ার তুলনায়) সর্বাধিক সাড়াদানকারী।”(ইমাম আহমদ,আল-মুসনাদ, মুয়াচ্ছাসাতুর রিসালা, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪২১ হি., খ.১৭, পৃ.২১৩, হা.নং-১১১৩৩; ইমাম হাকিম, আল-মুস্তাদরাক, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, ১৪১১ হি. খ.১, পৃ.৬৭০, হা.নং-১৮১৬) দোয়ার সময় যদি ‘লাইলাতুল বরাতের মত বরকতময় হয়, স্থান যদি সম্মানিত হয় যেমন হেরেম শরিফ, মসজিদে নববী, মসজিদে আক্বসা, নবী ও আউলিয়ায়ে কিরামের মাযার শরীফ ইত্যাদি এবং আসমায়ে হুসনা, নবী ও আউলিয়ায়ে কিরামের অসীলার মাধ্যমে যদি দোয়া হয়, তাহলে এ দোয়া কবুলের আশা প্রবল। ইবনে রজব হাম্বলী বলেন, লাইলাতুল বরাতের রাতে মুমিনদের উচিত আল্লাহ্র কাছে নিজ গুণাহ্ মাফ, গুনাহ্ ঢেকে রাখা ও বালা মুসিবত দূর হওয়ার জন্য দোয়া করা এবং ইখলাসের সাথে তাওবা করা। কারণ, এ বরকতময় রাতে তিনি তাওবা কবুল করেন এবং অগণিত লোকদের ক্ষমা করে দেন।( শাইখ ইসমাইল হক্বী, প্রাগুক্ত, খ: ১ম, পৃ: ২২৩,২৪৩;ইমাম কুশাইরী, আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ, প্রকাশনা ও তারিখ বিহীন, পৃ. ১২০)
(গ) অন্যান্য আমল : রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতে জান্নাতুল বক্বীতে গিয়ে যিয়ারত করতেন এবং ঈসালে সওয়াব করতেন। তাই আমাদের জন্য এ রাতে নবী অলীদের মাযার শরীফ, পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের কবর যিয়ারত করা মুস্তাহাব। যে কোন ভাল কাজ করা উত্তম যেমন কুরআন তিলাওয়াত করা বা শ্রবণ করা , হাদিস শরিফ পাঠ করা , তাসবীহ পাঠ করা, দান সদকা করা এবং নবী করিম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাসের ওপর দরূদ পাঠ করা ইত্যাদি। যেমন হযরত জাফর সাদেক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, ‘যে ব্যক্তি শাবান মাসের প্রতিদিন নবী করিম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর সাতশত বার দরূদ পাঠ করবে, তাঁর দরূদ রাসূলের দরবারে পৌঁছানোর জন্য আল্লাহ্ তায়ালা অনেক ফেরেশতা নিয়োগ করবেন। অতঃপর তিনি তাঁদেরকে নির্দেশ দিবেন, যেন তাঁরা কিয়ামত পর্যন্ত দরূদ পাঠকারীর জন্য ক্ষমা চাইতে থাকে।’ হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, ‘আমি লাইলাতুল বরাতের অংশকে তিন ভাগে ভাগ করেছি। রাতের প্রথমভাগে আমি রাসূলুল্লাহর ওপর দরূদ পরি, ২য় ভাগে আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা চাই এবং ৩য় ভাগে নামায পড়ি।’
এ রাতে সদকা করাও উত্তম কাজ। কারণ গোপন সদকা আল্লাহ্র রাগ উপশম করে। এ কারণে হযরত যয়নুল আবেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু রুটি বা ময়দার বস্তা নিজ পিঠে বহন করে রাতের অন্ধকারে সদকা করতেন। মানুষের উপকারে আসে এমন প্রত্যেক বস্তু সদকা করা যাবে যেমন যায়নুল আবেদীনের মত রুটি দেওয়া। এ ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে প্রচলিত হালুয়া রুটি সদকা করতেও কোন আপত্তি নেই; বরং সওয়াবের কাজ। কারণ বরকতময় কোন সময়ে সদকা করা অন্য সময়ে সদকা করার চেয়ে উত্তম। যেমন রমজানে সদকা করলে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়। শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে হালুয়া দেওয়া সর্বপ্রথম প্রচলন করেন ওয়াযির ফখরুল মালিক মুহাম্মদ বিন আলী ৪০৭ হিজরীতে। তিনি অত্যন্ত দানবীর ছিলেন এবং প্রতিদিন এক হাজার গরিবকে পোশাক প্রদান করতেন। শাবান মাসের পনের তারিখ দিনে রোযা রাখা মুস্তাহাব। কেননা মহানবী নিজে রাখতেন এবং আমাদের রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি এ দিনে রোযা রাখবে, সে অতীত ও ভবিষ্যৎ দুই বছরের মকবুল রোযার সওয়াব পাবে। সুতরাং সৎ কাজের মাধ্যমে এ রাত ও দিন অতিবাহিত করা উচিত।
কুরআন, সুন্নাত, সালফে সালেহীনের আমল ও উক্তির মাধ্যমে বোঝা গেল যে, শাবান মাসের পনের তারিখের রাত অত্যন্ত বরকতময়, যা জেগে ইবাদতের মাধ্যমে উদ্যাপন করা মুস্তাহাব। সময়ের নিজস্ব কোন গুণ না থাকলেও অন্য কারণে তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। যেমন সর্বোত্তম মাস হচ্ছে রমজান, কারণ রোযা ও কুরআন অবতীর্ণ হবার কারণে। সর্বোত্তম দিন হচ্ছে নবীর আগমনের দিন, যেহেতু তিনিই সবচেয়ে বড় নিয়ামত এবং তারপর হচ্ছে শুক্রবার। এভাবে ব্যক্তির কারণে স্থানের মর্যাদাও ভিন্ন হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ্র রওজা শরিফের স্থানটি আরশ, কুরছি, মক্কা, হেরেমসহ সকল স্থান থেকে উত্তম। এতে কারো দ্বিমত নেই।
( শাইখ ইসমাইল হক্বী, প্রাগুক্ত, খ: ১ম পৃ: ২৪৩ ,ইবনে রজব হাম্বলী, প্রাক্তক্ত, খ, ১ম, পৃ: ১৩৮;আব্দুল হাই লকনবী, আল-আছারুল
মারফুয়াহ, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, খ. ১ম পৃ: ৮১-৮২;আলা হযরত, ফতোয়ায়ে রজভীয়া, প্রাগুক্ত, ১৮২;ফতোয়ায়ে দেওবন্দ,
প্রাগুক্ত; হাসান শুরুন বুলালী, প্রাগুক্ত;ইমাম সাখাভী, আল-কাত্তলূল ব’দী, দারুর রাইয়ান লিত্-তুরাস, পৃ: ২০৮-২০৯;আবু নয়ীম
আল- ইসফাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া ওয়া ত্বাবকাতুল আসফিয়া, দারুল কিতাব আল-আরবী, বৈরুত, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪০৫ হিজরী, খ: ৩য়, l
উল্লিখিত বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, শবে বরাত’ উদযাপন করা সম্পূর্ণ শরীয়ত সম্মত। এতদসত্ত্বেও কিছু বিরোধীমহল আমাদেরকে এ বরকতপূর্ণ রাতের আমল থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে আর বলে বেড়ায় কুরআন-হাদীসে এ ব্যাপারে কিছুই নেই। এ সকল ব্যক্তিদের কথা থেকে আমাদের বেঁচে থাকা একান্ত প্রয়োজন। তবে এ রাতের আমল সম্পর্কে যথেষ্ট ইসরাঈলি বর্ণনা রয়েছে। এ বর্ণনাগুলো পরিহার করা একান্ত প্রয়োজন। এ প্রবন্ধে ইসরাঈলি বর্ণনা পরিহার করা হয়েছে।
মুফতি নেয়ামত উল্লাহ,
বি এ (অনার্স),এম এ (মাষ্টারস)
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এম এফ, (কামিল ফিকহ)
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্রগ্রাম।
সংকলনেঃ মুহাম্মদ হাসান