জাতিসংঘের বৈশ্বিক জনসংখ্যা পরিস্থিতিবিষয়ক তথ্যমতে, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে চলতি বছরের মধ্যবর্তী সময়ে চীনকে টপকাতে যাচ্ছে ভারত। দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশির বয়স ৩০ বছরের কম। অর্থাৎ কর্মক্ষম তরুণদের সংখ্যা বেশি। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশটির জনসংখ্যায় কর্মক্ষম বয়সী মানুষের অনুপাত হবে সর্বোচ্চ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম এ জনগোষ্ঠী শুধু ভারত নয়, প্রতিটি দেশই কোনো না কোনো পর্যায়ে এই শিখরে পৌঁছায়।
একটি নির্দিষ্ট সময় পর তা আবার কমতে শুরু করে। এই শিখরকে কেন্দ্র করে প্রতিটি দেশের অর্থনীতিরও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। যার সুফল ভোগ করছে হংকং, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ানসহ আরও অনেক দেশ। অর্থাৎ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতি যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিতে দেশগুলোর বিস্ময়কর উত্থান হয়েছে।
একটি দেশের জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক কাঠামো অনুযায়ী কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৬৪ বছর) যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে (০-১৪ বছর এবং ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে) অতিক্রম করে, তখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১। মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ তরুণ, যাঁদের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৪ লাখ।
অন্যদিকে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ৬২ শতাংশ, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে, সংখ্যায় যা ১০ কোটি ৫০ লাখ। ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধা ভোগ করে আসছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সুবিধা ২০৩৮ সাল পর্যন্ত চলমান থাকবে। সে অনুসারে বর্তমানে আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মধ্যবর্তী সময়ে অবস্থান করছি।
একটি দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেশি হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তরুণ জনগোষ্ঠী। তরুণদের বিপুল অংশ সম্ভাবনার সুযোগ হিসেবে গণ্য হবে, যদি প্রতিটি কর্মক্ষম মানুষকে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া যায়। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের কর্মক্ষম জনগণকে ব্যবহার করতে পারলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাসহ সামাজিক অন্যান্য সূচকের উন্নয়ন হবে।
অর্থাৎ জিডিপি থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স আহরণ, দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণসহ বিভিন্ন সূচকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হতে পারে বিরাট সুযোগ। তাই এ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করার সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। সে জন্য বর্তমান বাজারব্যবস্থায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সামনে রেখে তারুণ্যকে চাকরির বাজারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।
এ ছাড়া ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে অনেক বাজার সুবিধা থাকবে না। সে ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থায় সক্ষমতার জন্য দক্ষতার ভিত্তিতে তরুণদের গড়ে তুলতে হবে।
দেশের জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে কাজ করছে সরকার। স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলোয় বিস্ময়কর উন্নয়ন ঘটেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ অন্যান্য খাতে সাফল্যের পেছনে কয়েক দশকে জনসংখ্যার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বড় ভূমিকা রেখেছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগের হার বেড়েছে। তাতে কর্মক্ষম মানুষের জন্য যেমন নতুন কর্মক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক খাতেও গতিশীলতা বেড়েছে।
আশার কথা, করোনা–পরবর্তী সময়েও তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সেক্টরে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে ব্যাংকগুলো ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উদ্যোক্তা খুঁজে ঋণ প্রদানে ব্যাংকগুলো উদ্বুদ্ধ করছে। ফলে ঋণ গ্রহণে পুরুষদের পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসছেন। নারী বা পুরুষ স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি বহু লোকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, আমাদের দেশে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ৪৫ শতাংশে উন্নীত করা হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অতিরিক্ত বাড়বে শতকরা ১ ভাগ। বিবিএসের সর্বশেষ জরিপের তথ্যমতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ৪২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তাই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দ্রুত রূপান্তরশীল বিশ্ব ম্যানুফ্যাকচারিং বাজার থেকে পূর্ণ সুবিধা পেতে বাংলাদেশে প্রযুক্তি, পুঁজি ও নিবিড় উৎপাদনদক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া শিল্পায়নের ফলে প্রতিবছর দেশে প্রায় ২১ লাখ তরুণের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলমান রয়েছে। প্রতিবছর নতুন কলকারখানা গড়ে উঠছে।
তাতে শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ফলে দেশে সামগ্রিকভাবে ব্যবসাক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে, যা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শিল্পায়নে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর দক্ষতা কাজে লাগানো হচ্ছে মূল লক্ষ্য।
তবে প্রযুক্তি এনে দেয় নতুন মাত্রা। চাকরিদাতারা চান সৃষ্টিশীল চিন্তার সমস্যার সমাধানে সক্ষম এবং তথ্য, প্রযুক্তি ও দক্ষতাগত জ্ঞান অর্জন করা কর্মী। ৫০ বছর আগের প্রযুক্তি ও বর্তমান সময়ের প্রযুক্তি অনেক পার্থক্য গড়ে দেয়। অন্যদিকে কোভিড-১৯–এর কারণে প্রযুক্তিগত চাহিদা আরও বেড়ে যায়। তাই দেশের আইটি শিল্পের প্রসার ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক বা সফটওয়্যার টেকনোলজি স্থাপন করা হচ্ছে।
এ ছাড়া সরকারি দপ্তরগুলোয় ইন্টার্নশিপ চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাতে সদ্য গ্র্যাজুয়েট তরুণদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, চিন্তার দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি বাড়বে, যা দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির ফলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়ছে।
শহুরে অর্থনীতির পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশে প্রবাসী আয় বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। বিএমইটির এক তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাত লাখ কর্মী বিদেশে যান। ২০২০ সালে করোনার জন্য ২ লাখ ১৮ হাজারে নেমে আসে। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে ৬ লাখ ১৭ হাজার কর্মী বিদেশে যান। ২০২২ সালে ১১ লাখ ৩৬ হাজার কর্মী এবং চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে ৩ লাখ ২৩ হাজার কর্মী বিদেশে গমন করেন।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে ইউরোপসহ সারা বিশ্বে দক্ষ কর্মীর চাহিদা তৈরি হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কৌশল নির্ধারণ করে দক্ষ কর্মী তৈরি করা আবশ্যক। সে চাহিদা পূরণকল্পে প্রয়োজনে কারিকুলামে পরির্বতন এনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষা ও কর্মভিত্তিক প্রশিক্ষণে যথোপযুক্ত বিনিয়োগ ও প্রণোদনার মাধ্যমে এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে একটি সুশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। প্রশিক্ষণ কৌশলের লক্ষ্য হবে কর্মসংস্থান উপযোগী দক্ষতা। এ ছাড়া চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপ করতে হবে।
জনমিতির এ সুবিধা যথাযথ কাজে লাগানোর একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে। জন্মহার হ্রাস ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির কারণে পূর্বের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীই তিন-চার দশক পর সমাজ তথা দেশের জন্য বোঝা হিসেবে পরিগণিত হবে। অর্থাৎ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পিরিয়ড শেষ হলে নির্ভরশীল জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। তাই জনমিতির নির্দিষ্ট সময়ে সঠিক ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখাই মূল লক্ষ্য।
এ ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নসহ ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন, তা নির্ভর করছে যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর। তা অনেকটাই এগিয়ে থাকবে যদি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায়।
লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা