কুড়িগ্রামে সাংবাদিক নির্যাতন মামলায় সাবেক ডিসি ও তিন ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে চার্জশিট

আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি মো. আরিফুল ইসলাম রিগানকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের মামলায় কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন ও তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
মঙ্গলবার (২৮ জুলাই) বিকালে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) ও পিবিআই রংপুরের পরিদর্শক রায়হানুল রাজ দুলাল কুড়িগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চার্জশিট দেন। মামলার আইও রায়হানুল রাজ দুলাল এবং কোর্ট পরিদর্শক নজরুল ইসলাম জুয়েল এ তথ্য প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।
কোর্ট পরিদর্শক নজরুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘আমরা চার্জশিট পেয়েছি। পরবর্তী ধার্য তারিখে আদালতে নথি উপস্থাপন করা হবে।’
আদালত সূত্র জানায়, চার্জশিটে সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন, সাবেক আরডিসি নাজিম উদ্দিন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা এবং এসএম রাহাতুল ইসলামকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৯টি ধারায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। পরবর্তী ধার্য তারিখে সংশ্লিষ্ট আদালতে নথি উপস্থাপন করা হবে।
চার্জশিট দাখিলের খবরে বাদী ও ভুক্তভোগী সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগান বলেন, ‘দীর্ঘ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় পর চার্জশিট জমা হলো। আসামিরা সবাই প্রভাবশালী। বিভাগীয় মামলায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলেও তারা চাকরিতে বহাল ছিলেন। তারা বিভিন্ন সময় মামলার তদন্তকাজে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছেন। এরপরও চার্জশিট দাখিল করায় তদন্ত সংস্থা পিবিআইকে ধন্যবাদ। আশা করি আদালতে ন্যায়বিচার পাবো।’
সাংবাদিক আরিফের পক্ষে রিটকারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘২০২০ সালের ৩ মার্চ হাইকোর্টের নির্দেশে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে বর্বরোচিত নির্যাতনের ঘটনার তদন্তপূর্বক কুড়িগ্রামের তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীন, তৎকালীন আরডিসি নাজিম উদ্দীন এবং দুই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা করা হয়। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর পর পিবিআই তদন্ত শেষে এজাহারনামীয় চার আসামির বিরুদ্ধে অপরাধের সত্যতা পেয়ে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। বিলম্ব হলেও এটা একটা দৃষ্টান্ত।’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা যাচ্ছে, আসামিরা এতদিনেও আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন গ্রহণ করেননি। তারা পলাতক থাকলেও নিয়মিতভাবে সরকারি চাকরিতে বহাল রয়েছেন, যা আইন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। বিভাগীয় তদন্তেও তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, যা তাদের প্রশাসনিকভাবে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে। এরপরও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া শুধুমাত্র বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ নয়, বরং এটি প্রশাসনের অভ্যন্তরে প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি উদাহরণ। আমি আইনজীবী হিসেবে প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রত্যশা করি।’
প্রসঙ্গত, কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নামে জেলা প্রশাসনের একটি পুকুরের নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ১৩ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে জেলা শহরের ধরলা ব্রিজের পূর্ব পাড়ে নেওয়া হয়। পরে ফিরিয়ে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন ওই সময়ের আরডিসি নাজিম উদ্দিন, এনডিসি রাহাতুল ইসলাম এবং মোবাইল কোর্টের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমাসহ জেলা প্রশাসনের কর্মচারীরা। আরিফের বাড়িতে কোনও তল্লাশি না চালালেও তার কাছ থেকে আধা বোতল মদ ও দেড়শ’ গ্রাম গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ এনে মোবাইল কোর্টের নামে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। মধ্যরাতে বাড়ি থেকে একজন সাংবাদিককে ধরে এনে সাজা দেওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
গণমাধ্যমে এ ঘটনা প্রচার হলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় পরদিন ঘটনাস্থলে যান রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) আবু তাহের মো. মাসুদ রানা। তার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন ও সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এসএম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়।
১৫ মার্চ পরিবারের আবেদন ছাড়াই আরিফের জামিনের ব্যবস্থা করে জেলা প্রশাসন। কারামুক্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনসহ তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রাম সদর থানায় এজাহার দেন সাংবাদিক আরিফ। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে সে বছরের ৩১ মার্চ মামলা রেকর্ড করে কুড়িগ্রাম সদর থানা পুলিশ। পাশাপাশি উচ্চ আদালতের নির্দেশে আরিফকে দেওয়া সাজা স্থগিত করা হয়।
সম্পাদকঃ সারোয়ার কবির | প্রকাশকঃ আমান উল্লাহ সরকার
যোগাযোগঃ স্যুইট # ০৬, লেভেল #০৯, ইস্টার্ন আরজু , শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, ৬১, বিজয়নগর, ঢাকা ১০০০, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ +৮৮০ ১৭১১৩১৪১৫৬, টেলিফোনঃ +৮৮০ ২২২৬৬৬৫৫৩৩
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫