কোটি টাকা খরচ করে সড়কসংস্কারের নামে সড়কটি নষ্ট করা হয়েছে
প্রকাশকালঃ
১৩ জুন ২০২৩ ০৩:১০ অপরাহ্ণ ১৭৭ বার পঠিত
‘কাম নাই, কোটি কোটি খরচ করি আস্তাখান নষ্ট কইল্লেন। সামান আস্তাখান এলা যেইত্তি সেইত্তি পাথর উঠে রহেছে। পইত্তেক দিন এক্সেডেন্ট হছে। মাইনসিও মারা যাছে।
এই আস্তাত যাহে যাছে, ওরে বারোটা বাজেছে। আর টায়ার কম্পানিলার ব্যবসা জমিছে।’ ক্ষোভে কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভ্যানচালক সাজিম আলী।
শুধু সাজিম আলীই নন, পঞ্চগড় বাংলাবান্ধা মহাসড়কটিতে চলমান সংস্কারকাজে দুর্ভোগ আর ক্রমাগত দুর্ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা।
তাদের অভিযোগ হলো, সড়কটিকে সংস্কারের নামে মানুষের দুর্ভোগ আর প্রাণহানীর ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। তবে সড়ক বিভাগ বলছে, সড়কটিকে টেকসই করতে এ কাজ করা হচ্ছে।
জানা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে প্রায় ১৮৭ কোটি টাকায় পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত প্রায় ৫৩ কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ২০১২-১৩ অর্থবছরে।
কাজ শেষ হওয়ার পর পঞ্চগড় বাংলাবান্ধা মহসড়কটিকে তুলনা করা হতো বিমানের রানওয়ের সাথে। মসৃণ পিচঢালা সড়কটি আশপাশের এলাকার সৌন্দর্য অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই সাথে পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই মহাসড়ক। সড়কটি স্থানীয়দের কাছে অহংকারের জায়গাও।
তবে গত বছর সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে এই মহাসড়কটিকে আরো টেকসই করতে ডিবিএসটি (ডাবল বিটুমিনাস সারফেস ট্রিটমেন্ট) প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
গত বছরের জুনে প্রায় ২১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫২.৫ কিলোমিটার সড়কে কাজ শুরু করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মোজাহার এন্টারপ্রাইজ। দুই স্তরে বিটুমিন মেশানো পাথর ফেলা হচ্ছে সড়কে। প্রথম লেয়ার দেওয়ার কয়েকদিন পর দ্বিতীয় লেয়ার দেওয়া হচ্ছে। এ বছরের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মহাসড়কের এই সংস্কার কাজ উল্টো তাদের ভোগান্তি বাড়িয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জুনের মধ্যে কাজ শেষ করতে তাড়াহুড়ো করছে। এতে কাজের মানও খারাপ হচ্ছে। সেই সাথে পুরো সড়কজুড়ে পড়ে থাকা সূঁচালো পাথরে টায়ার পাংচার হয়ে যাচ্ছে। আলগা পাথরে পিছলে পড়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। একাধিক প্রাণহানীর ঘটনাও ঘটেছে।
গত ৯ জুন পঞ্চগড় বাংলাবান্ধা মহাসড়কের দশমাইল এলাকায় সড়কে ট্রাকচাপায় প্রাণ যায় শরিফুল ইসলাম (২৭) ও শেখ ফরিদ (২৬) নামে মোটরসাইকেল আরোহী চাচা-ভাতিজার। গত ২৩ মে পঞ্চগড় বাংলাবান্ধা মহাসড়কের মাঝিপাড়া এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি যাত্রীবাহী বাস উল্টে যায়। আহত হন বাসের অন্তত ১৮ জন যাত্রী। ৯ এপ্রিল বুড়াবুড়ি ভেরসা সেতু এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মোটরসাইকেল আরোহী সাইফুল ইসলাম তারেক (২৭)। ১৫ মার্চ এই সড়কের বুড়াবুড়ি মান্দুলপাড়া এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় ফজলুল হক (৪২) ও তার ভাতিজি সুমাইয়া আক্তার মীমের (১২)। এ ছাড়া প্রতিদিন ছোট খাটো দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এসব দুর্ঘটনার পেছনে সড়কের বর্তমান সংস্কার কাজকেই দায়ী করছেন স্থানীয়রা।
আনারুল ইসলাম নামের এক পথচারী বলেন, এমনভাবে সড়কের কাজ করছে যে পাথরগুলো আলাদা হয়ে উঠে থাকছে। এছাড়া পিচ রোদে গলে যাচ্ছে। হাঁটার সময় পায়ের জুতোর সাথে লেগে যাচ্ছে। কাজটি যত্ন করে করেনি ঠিকাদার। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভালো সড়কটি এখন নষ্ট করা হয়েছে।
তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর এলাকার আমিনুর রহমান বলেন, কয়েকদিন আগে আমি আমার ছেলেকে নিয়ে বাইকে করে পঞ্চগড় যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথে সাড়ে ৯ মাইল এলাকায় আলগা পাথরের সাথে পিছলে আমরা পড়ে যাই। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও মারাত্মকভাবে আহত হই আমরা। সড়কের এই অবস্থার কারণেই প্রতিদিন আমার মতো অনেক মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
পঞ্চগড় সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ বলেন, এই মহাসড়কটি নির্মাণের ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে কোনো মেনটেইন্যান্স হয়নি। মহাসড়কটিকে আরো টেকসই করার জন্য ডিবিএসটি কাজ করা হচ্ছে। এতে সড়কের স্থায়িত্ব যেমন বাড়বে তেমনি দুর্ঘটনাও কমে আসবে। আর এর মধ্যে যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে তা অতিরিক্ত গতির কারণে হয়েছে।