সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির হত্যাকাণ্ডের ১৩ বছর পেরিয়ে গেছে, তবু বিচারপ্রক্রিয়া এখনো অগ্রগতির মুখ দেখেনি। স্বজন-সহকর্মীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরও তদন্তে উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য আসেনি। ক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকার ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করার লক্ষ্যে টাস্কফোর্স গঠন করলেও তিন মাস পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
নানা স্তরে তদন্ত পরিচালিত হলেও রহস্য উদ্ঘাটনে কোনো কার্যকর সূত্র পাওয়া যায়নি। সেনা-পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা, সাংবাদিক নেতা ও টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকসহ ৬২ জনকে নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তদন্তের কূলকিনারা পাওয়া যায়নি। আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় ১১৫ বার পেছানো হয়েছে।
স্বজনদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকার তদন্তে সময়ক্ষেপণ করে মামলাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। নতুন সরকার টাস্কফোর্স গঠন করায় তারা আশাবাদী, তবে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না। তারা দাবি করছেন, যেনতেনভাবে তদন্ত শেষ না করে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা হোক।
টাস্কফোর্সের প্রধান, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোস্তফা কামাল জানান, যাদের নাম তদন্তে উঠে এসেছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য মেলেনি। কেউ বলেছেন, তিনি অন্যের কাছ থেকে শুনেছেন, আবার কেউ দাবি করেছেন, ইউটিউবে দেখেছেন। তদন্তের ভিত্তি শোনা কথা হতে পারে না। তবে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে এবং সম্ভাব্য পাঁচ-সাতটি পথ ধরে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সুরাহা না হলে সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন করা হবে।
তদন্ত সূত্র জানায়, সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমান, সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মনজুরুল আহসান বুলবুল, এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানসহ আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে কেউই তদন্তে কার্যকর কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
২০১২ সালে লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে মাহফুজুর রহমান দাবি করেছিলেন, পরকীয়ার বলি হয়েছেন সাগর-রুনি। সেই সময় তিনি আরও বলেছিলেন, তাদের বাসায় মদের আড্ডা বসত। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সাংবাদিকদের চাপের মুখে তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন, যা সত্য নয়।
সাগর-রুনির পরিবারের সদস্যরা এখনো ন্যায়বিচারের অপেক্ষায়। মামলার বাদী, রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, বর্তমান সরকারের উদ্যোগে টাস্কফোর্স গঠিত হওয়ায় তারা আশাবাদী। তবে তিনি চান, প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক এবং নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন।
সাগরের মা সালেহা মনির বলেন, তিনি চান নতুন তদন্তে প্রকৃত খুনি শনাক্ত হোক। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘এটি ডাকাতির ঘটনা নয়। হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত, এবং খুনিদের ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত হওয়া দরকার।’
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ফ্ল্যাট থেকে সাগর-রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। সাগর ছিলেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক, আর রুনি ছিলেন এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক।
মাছরাঙার প্রধান সম্পাদক রেজোয়ানুল হক রাজা বলেন, আগের সরকারের সময়ে হয়তো তদন্তে এমন কিছু বেরিয়ে এসেছিল যা প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই, তাই প্রকৃত খুনিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে বাধা থাকার কথা নয়।
র্যাব বিভিন্ন সময়ে সন্দেহভাজন হিসেবে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার দেখালেও কোনো কার্যকর ক্লু খুঁজে পায়নি। এমনকি হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র, ডিএনএ নমুনা ও অন্যান্য আলামত ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হলেও তা থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট ক্লু মেলেনি।
২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চার সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে, যার নেতৃত্বে রয়েছে পিবিআই। ৪ নভেম্বর টাস্কফোর্স মামলার তদন্তভার নেয় এবং আগামী ৪ এপ্রিল তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
তদন্তের গতি যতই ধীর হোক, সাগর-রুনির পরিবার ও সহকর্মীরা আজও আশায় বুক বাঁধছেন—একদিন প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হবে এবং দোষীরা বিচারের সম্মুখীন হবে।