ভারতীয় নারীরা যৌন হয়রানি রুখতে যে ‘অস্ত্র’ ব্যবহার করেন
প্রকাশকালঃ
২১ মার্চ ২০২৩ ০৩:১৬ অপরাহ্ণ ১৮৬ বার পঠিত
ভারতে প্রায় প্রতিটি নারীই যৌন হয়রানির শিকার হয়। সেটা জনাকীর্ণ স্থানে, বাসে বা রাস্তায়। অনেক নারীই চেষ্টা করে এ ধরনের আচরণের পাল্টা জবাব দিতে। নিজের কাছে যা আছে সেটাকেই কাজে লাগায় তাদের হেনস্তাকারীদের আঘাত করার জন্য।
বিবিসি প্রতিনিধি গীতা পান্ডে নিজের অভিজ্ঞতার জানান। তিনি বলেন, ‘নারীরা যা পেত তাই ব্যবহার করত। কয়েক দশক আগেও কলকাতায় কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ট্রামে যাতায়াত করত। ভিড়ের মধ্যে সেই ট্রামে আমি আর বন্ধুরা যাতায়ত করতাম। তখন আমরা আমাদের ছাতা ব্যবহার করতাম। আমরা অনেকেই লম্বা নখ রাখতাম। বেশ ধারালো করেই রাখতাম। যাতে হেনস্তাকারীদের নখের আঁচড়া দেওয়া যায়। অন্যরা আবার নিজেদের হিল দিয়ে এ ধরনের পুরুষদের আঘাত করত। যারা ভিড়ের সুযোগ নিয়ে আমাদের যৌন হয়রানি করত।’
তবে অন্য সব কিছুর চেয়ে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হলো ‘সেফটি পিন’। ১৮৪৯ সালে এই সেফটি পিনের উদ্ভাবন। এর পর থেকেই এটি বিশ্বজুড়ে নারীরা তাদের পোশাকে ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু শুধু পোশাকে নয়, হয়রানিকারীদের শক্ত জবাব দিতেও এটি ব্যবহার করছে।
কয়েক মাস আগে ভারতের বেশ কয়েকজন নারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে স্বীকার করেছিলেন, তারা সব সময় তাদের হ্যান্ডব্যাগে সেফটি পিন রাখেন। এই ছোট জিনিসটি দিয়ে জনাকীর্ণ স্থানে বিকৃত আচরণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাদের পছন্দের অস্ত্র।
এমনই একজন দীপিকা শেরগিল। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমি নিয়মিত বাসে করে অফিসে যাতায়াত করতাম। ঘটনাটি কয়েক দশক আগে ঘটেছিল। কিন্তু কিছুটা মনে আছে। তখন আমার বয়স ছিল ২০। আর যে লোক আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছিল তার বয়স ছিল ৪০। সে সব সময় একটি ধূসর সাফারি পরত, পায়ে খোলা স্যান্ডেল পরত এবং একটি চামড়ার ব্যাগ নিত সঙ্গে। লোকটি সব সময় আমার পাশে এসে দাঁড়াত। ঝুঁকে পড়ত আমার ওপর। আমার পিঠে তার কুনই দিয়ে ঘষা দিত আর ড্রাইভার যখনই ব্রেক লাগাত তখনই আমার ওপর পড়ে যেত।’
তিনি বলেন, ‘সেই দিনগুলোতে খুব ভীত থাকতাম এবং নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এমন কিছু করতাম না। কয়েক মাস ধরে নীরবে ভুগেছি। কিন্তু এক সন্ধ্যায় সে বাসে আমার সিটের পাশে দাঁড়িয়ে হস্তমৈথুন শুরু করল এবং আমার কাঁধে বীর্যপাত করল। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার যথেষ্ট হয়েছে!’
তিনি আরো বলেন, ‘নিজেকে অপবিত্র লাগছিল। বাসায় পৌঁছে আমি সত্যিই অনেকক্ষণ ধরে গোসল করেছি। আমি আমার মাকেও বলিনি আমার সঙ্গে কী ঘটেছে। সেই রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছি। কিন্তু তারপর আমি প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করি। আমি তার শারীরিক ক্ষতি করতে চেয়েছিলাম, তাকে আঘাত করতে চেয়েছিলাম। এ ধরনের জঘন্য কাজ যেন ওই লোক না করতে পারে আর।’
এর পরদিন শেরগিল হিল জুতা আর সেফটি পিন নিয়ে বাসে ওঠেন। ওই লোক তার পাশে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সে তার সিট থেকে উঠে যান। এরপর হিল জুতা দিয়ে ওই লোকের পা পিষে ফেলেছিলেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘তার চিৎকার শুনে আমি খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।’ শুধু তা-ই নয়, নিজের কাছে রাখা সেফটি পিনটি দিয়ে লোকটির কপালে খোঁচা দিয়ে দ্রুত বাস থেকে নেমে পড়েন তিনি। যদিও তিনি আরো এক বছর ধরে ওই বাসে যাতায়াত করেছিলেন; কিন্তু ওই লোকটিকে আর দেখেননি। শেরগিলের এই গল্পটি জঘন্য হলেও কিন্তু বিরল নয়।
শেরগিলের অন্য একজন সহকর্মীও তার সঙ্গে ঘটা একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। ত্রিশের কোঠার ওই নারী রাতের বাসে ভারতের দক্ষিণের নগরী কোচি থেকে বেঙ্গালুরু যাচ্ছিলেন। বাসে এক ব্যক্তি বারবার তার হাত ধরার চেষ্টা করছিল। তিনি বলেন, ‘শুরুতে আমি তার হাত সরিয়ে দিই, ভেবেছিলাম দুর্ঘটনাবশত এটি হয়েছে। কিন্তু যখন আবারও একই কাণ্ড হলো, আমি বুঝতে পারলাম সে ইচ্ছা করে এটি করছে। সেদিন আমার হিজাবে থাকা সেফটি পিন আমাকে বাঁচিয়ে দেয়।’ সেফটি পিন দিয়ে ওই লোকের হাতে তিনি খোঁচা মেরেছিলেন।
২০২১ সালে ১৪০টি অনলাইন সমীক্ষা অনুসারে, ভারতে ৫৬ শতাংশ নারী পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে মাত্র ২ শতাংশ পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। একটি বিশাল সংখ্যক নারী জানিয়েছে, তারা নিজেরাই পদক্ষেপ নিয়েছে বা পরিস্থিতি উপেক্ষা করতে চেয়েছে। সরে যাওয়ার কারণ তারা এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় না। ৫২ শতাংশের বেশি নারী জানিয়েছে, তারা নিরাপত্তার কারণে পড়া বা চাকরির সুযোগ ছেড়ে দিয়েছে।
কল্পনা বিশ্বনাথ, তিনি ভারতের সেফটি পিন নামে একটি সামাজিক সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠা। যিনি নারীদের সব স্থানে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য কাজ করেন। তিনি বলেনর, যৌন নিগ্রহের শিকার শুধু ভারতীয় নারীরাই হয় না, বরং পুরো বিশ্বের নারীরা এই অবস্থায় পড়ে।
নারীদের প্রতি আরো সংবেদনশীল হতে চালক ও সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। নারীরা যাতে বিপদে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সাহায্য চাইতে পারে সে জন্য পুলিশ নানা ধরনের মোবাইল অ্যাপ এবং হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছে। তবে কল্পনা বিশ্বনাথ মনে করেন, শুধু পুলিশ দিয়ে সব সময় এ সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। তার মতে, গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হলো এ বিষয়ে বেশি বেশি কথা বলা। গণমাধ্যমে প্রচার চালানো। যাতে মানুষের মনে গেঁথে যায়, কোনটি ভালো এবং কোনটি খারাপ আচরণ।