অনুবাদ: হযরত আমর ইবনুল আহওয়াস আলজুসামী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত বিদায় হজ্বের ভাষণ শ্রবণ করেছেন, নবীজি আল্লাহ্ তা‘আলার প্রশংসা ও গুণগান বর্ণনা করেন, (উপস্থিত মানবম-লীর উদ্দেশ্যে) উপদেশবাণী এরশাদ করলেন, তোমরা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো! আমি তোমাদেরকে নারীদের ব্যাপারে সদাচরণের উপদেশ দিচ্ছি। কেননা মহিলারা তোমাদের কাছে তোমাদের ঘরে আবদ্ধ থাকে (তারা তোমাদের সহযোগী) এ ছাড়া তোমরা তাদের আর কিছুর মালিক নও তবে তারা যদি স্পষ্ট কোন অশ্লীলতায় লিপ্ত হয় তাহলে ভিন্ন কথা। [তিরমিযী শরীফ, হাদীস নম্বর-১০৮৩]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বিদায় হজ্বের ভাষণে নারীদের প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় ও করণীয় নির্দেশনা ও তাঁদের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যের শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গি আলোকপাত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক তাঁর পবিত্র জীবদ্দশায় বিশ্বমানব জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত প্রতিটি অমূল্য ভাষণ মানবজাতির মুক্তির সনদ হিসেবে স্বীকৃত।
১০ম হিজরির ৯ জিলহজ্ব রোজ শুক্রবার নবীজির পদধূলিতে ধন্য আরাফাতের বিশাল ময়দানে এক লক্ষ চব্বিশ হাজারের অধিক সাহাবায়ে কেরামের উপস্থিতিতে মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশ্যে নবীজির প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণ তাফসীর, হাদিস, ইতিহাসের ভাষায় বিদায় হজ্ব তথা ‘হাজ্জাতুল বিদা’ নামে প্রসিদ্ধ। বিশ্বমানবতার সামগ্রিক মুক্তি ও শান্তি স্থাপনে অধিকন্তু বিশ্ব মানবগোষ্ঠী ও নারী জাতির মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক ঐতিহাসিক যুগান্তকারী ভাষণ হিসেবে বিশ্ব ইতিহাসে স্মরণীয় অম্লান হয়ে থাকবে, এ ভাষণকে মুক্তির মাইলফলক ও আলোকবর্তিকা হিসেবে আখ্যা দিলে অত্যুক্তি হবে না। বিদায় হজ্বের ভাষণ ছিল নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অনবদ্য দলীল। এ ভাষণে রয়েছে নারী জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা সুরক্ষায় সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ইসলাম পুরুষের পাশাপাশি নারী জাতির কর্মকে যথার্থরূপে স্বীকৃতি দিয়েছে তাকে কখনো ‘মা’ হিসেবে, কখনো ‘স্ত্রী’ হিসেবে কখনো কখনো কন্যা হিসেবে, কখনো বোন হিসেবে সম্মান ও মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। পবিত্র কুরআনে নারী জাতির সৃষ্টিকে আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন- ‘‘আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের সহধর্মিনী সৃষ্টি করেছেন, যেন তাদের কাছে তোমরা বসবাস করতে পারো এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। [সূরা রুম: আয়াত নম্বর-২১]
নবীজি এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে নারীদের অধিকার ও মর্যাদা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে অনেক কল্যাণধর্মী অমূল্যবাণী বিঘোষিত হয়েছে। এ ভাষণে নবীজি আরো এরশাদ করেছেন-হে মানবম-লী! তোমাদের নারীদের প্রতি তোমাদের উপর কিছু অধিকার রয়েছে, তাদের উপরও তোমাদের কিছু অধিকার রয়েছে, তাদের উপর তোমাদের অধিকার হলো তোমরা আল্লাহর আমানত হিসেবে তাদেরকে গ্রহণ করেছো এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে তাদেরকে তোমরা হালাল করে নিয়েছো। হে মানবম-লী! তোমরা আমার কথা হৃদয়ঙ্গম কর। আল্লাহর বাণী তোমাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ আমি সম্পন্ন করেছি, আমি তোমাদের নিকট এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি যদি তোমরা তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে থাক তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। সুস্পষ্ট আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের সুন্নাহ্। [সীরাত ইবনে হিশাম, খ–৪র্থ, পৃ. ১৯০-১৯১]
নবীজি স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কে আরো এরশাদ করেছেন-
عَنْ معاوية بن حيدة رضى الله عنه قال قلت يا رسول الله ما حق زوجة احدنا عليه؟ قال ان تطعمها اذا تطعمت وتكسوها اذا اكتسبت ولاتضرب اللوجه ولا تقبح ولا تهجر الا فى البيت [رواه ابوداؤد]
হযরত মুআবিয়া ইবনে হায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমাদের উপর স্ত্রীর অধিকার কী? নবীজি এরশাদ করেন, তুমি যখন খাবে তাকে খাওয়াবে, তুমি যখন কাপড় পরিধান করবে, তাকেও (পোষাক) পরাবে। স্ত্রীর চেহারায় আঘাত করবেনা, গালমন্দ করবেনা, স্ত্রীর নিকট খারাপ কিছু দেখলে তাকে ঘরের মধ্যে রেখে তুমি অন্য বিছানায় ঘুমাবে। [আবু দাউদ, হাদীস নম্বর-১৮৩০]
বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যায় স্ত্রীর মাঝে অপ্রীতিকর খারাপ কিছু পরিদৃষ্ট হলে তাকে সতর্ক ও সংশোধন করার প্রত্যয়ে প্রতিবাদ স্বরূপ তাকে মনস্তাত্মিক চাপ সৃষ্টি করার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে, প্রয়োজনে তার শয়নকক্ষ পরিবর্তন করে দাও, সাময়িকভাবে সংশোধন হওয়া পর্যন্ত স্বামী অন্য একটি কক্ষে বা সাময়িক পৃথকতা অবলম্বন করবে।
নেক্কার নারীরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত
নারীরা পুরুষের সহযোগী ও সহায়ক শক্তি, প্রেরণা সৃষ্টিকারী, এ পৃথিবীতে যত অগ্রগতি উন্নয়ন উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, সবকিছুতেই পুরুষের পাশাপাশি রয়েছে নারী জাতির বিশেষ ভূমিকা ও অবদান। নারী জাতির উৎসাহ্ ও প্রেরণা পুরুষের সাফল্য ও অর্জনকে তরান্বিত করেছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
وعن عبد الله بن عمرو بن العاص رضى الله عنهما ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال الدينا ومتاع وخير متاع الدينا المرأة الصالحة [رواه النسائى]
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, গোটা পৃথিবীর সবটুকুই সম্পদ পার্থিব জীবনের সবচেয়ে উত্তম সম্পদ হলো নেককার স্ত্রী। [সুনানে নাসাঈ, হাদীস নম্বর-৩১৮০]
নারী জাতি গৃহের তত্ত্বাবধায়ক
স্বামীর গৃহে সন্তানের লালন পালন, সুন্দর আচরণ শিক্ষাদান পারিবারিক পরিম-লে সুচারুরূপে কার্য সম্পাদনে নারী জাতির অনন্য ভূমিকা স্বীকার্য। আদর্শ চরিত্র গঠনে মা জাতির ভূমিকা অপরিসীম। মাতৃক্রোড়ই শিশু সন্তানের পাঠশালা। নিজ ছেলে সন্তানকে ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে নীতি নৈতিকতা, সততা, ভদ্রতা, নম্রতা ও শালীনতা ও ছেলে সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ বির্নিমানে উপরন্ত ঘরের সার্বিক রক্ষাবেক্ষণ, স্বামীর সম্পদের সুষ্ঠু সংরক্ষণ সঠিক ব্যবহারে স্ত্রীর ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- المرأة راعية فى بيت زوجهاঅর্থাৎ নারী তার স্বামীর ঘরের তত্ত্বাবধায়ক। [সহীহ্ বুখারী শরীফ, হাদীস নম্বর- ৮৪৪]
ইসলাম নারী জাতিকে দিয়েছে অধিকারের স্বীকৃতি
পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হলো মানুষ। আদম আলায়হিস্ সালাম ও মা হাওয়া আলায়হাস্ সালামের মাধ্যমে পৃথিবীর সর্বত্র মানবজাতির বংশ বিস্তার। পৃথিবীর সূচনাতেই প্রতিনিধি হিসেবে পুরুষের স্বীকৃতির পাশাপাশি নারী জাতিও স্বীকৃতির মর্যাদা পেয়েছে। আসুন, নারী জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠায় পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ নয়। ইসলামই নারীর মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষার রক্ষাকবচ। নারীর অধিকার সংরক্ষণে ইসলামই আদর্শিক পাঠশালা।
আল্লাহ্ আমাদের নারী জাতিকে তাঁদের গৌরবময় অতীত ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ইসলামী আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।