ঢাকা প্রেস
মোঃ শফিকুল ইসলাম,চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিনিধি:-
ট্রেনটি প্রারাম্ভিক কলকাকলি স্টেশন থেকে যাত্রা, গন্তব্য মহাকাশ পর্যন্ত।শুনতে অবাক লাগার মত হলেই,বাস্তবে তাই।পুরোনো টিনশেড ভবনকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে আন্তঃনগর ট্রেনের আদলে একটি বিদ্যালয়কে।
অচেনা যে কেউ দেখলেই বলবে, স্টেশনে দাঁড়ীয়ে আছে আস্ত একটা আন্তঃনগর ট্রেন।এ দৃশ্য রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ধাদাশ গ্রামে।অজ পাড়া গ্রামের জরাজীর্ণ "ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়"টিকে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মূখী করার আকর্ষনের জন্য ট্রেনের আদলে রংকরা হয়েছে।প্রথম দেখায় বোঝার উপায় নেই, এটি কোনো স্কুল না আস্ত একটা ট্রেন।‘কলকাকলি স্টেশনে’ চারটি বগি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেস’। গন্তব্য—‘ধাদাশ টু মহাকাশ’। ছোট ছোট শিক্ষার্থী ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে। টিফিনের সময় এলোমেলো দাঁড়ীয়ে শিক্ষার্থীরা ,এমন সময় বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক রত্না খাতুন হুইশেল বাজিয়ে বললেন,তোমরা ঘোরাফের করোনা ‘ঠিক একটায় ট্রেন ছাড়বে।এসময়’ খিলখিলিয়ে হেসে এক শিক্ষার্থী বললো, ‘আমরা কিন্তু মহাকাশেই যাব।’শিশুদের এখনই মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন যে স্কুলটি দেখাচ্ছে, সেটির নাম ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায়। বাস্তবে বিদ্যালয়ে কোনো রেলগাড়ি নেই। তবে ১৯৬৭ সালে নির্মিত চারটি জরাজীর্ণ কক্ষকে রংতুলির আঁচড়ে সম্প্রতি রেলগাড়ির রূপ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি গ্রন্থাগার, অন্য তিনটি শ্রেণিকক্ষ। এই শ্রেণিকক্ষ ভীষণভাবে উপভোগ করছে খুদে শিক্ষার্থীরা।অথচ কয়েক বছর আগেই ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল।
ইটের দেয়াল আর টিনের ছাউনির সেই ঘরে ক্লাস করতে মন খারাপ হতো শিশুদের।ঝরে পড়ছিলো শিক্ষার্থী।এখন পরিত্যক্ত সেই ভবন শুধু শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি,দূরদুরান্ত থেকে অনেকই দেখতে আসছে ট্রেনের আদলের বিদ্যালটি।প্রধান শিক্ষক দিলরুবা খাতুনের হাতের ছোঁয়ায় পুরো স্কুলটিই বদলে গেছে। পরিপাটি করে সাজানো-গোছানো এ স্কুলে ঝরে পড়ার হার এখন শূন্য। এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০২২ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয়েছে স্কুলটি। রেলগাড়ির আদলে পুরোনো ভবনটি সাজিয়ে তোলার ছবি ছড়িয়ে পড়লে প্রশংসায় ভাসছেন প্রধান শিক্ষক।
১২ নভেম্বর সকালে স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, পুরো ক্যাম্পাসটি যেন একটি শিশুপার্ক। স্কুলের পুরো আঙ্গিনা জুড়ে ফুলের বাগানে ও পশুপাখির ভাস্কর্য। খেলার জন্য দোলনাহ নানা উপকরন। অফিস কক্ষের সামনে সুন্দর মঞ্চ। ছোট্ট মাঠের পুরোটিতেই দৃষ্টিনন্দন টালি বসানো। সব কটি শ্রেণিকক্ষই সাজানো-গোছানো। দেয়ালগুলো রঙিন ফুলে-ফলে। কাগজের ফুল দিয়ে শ্রেণিকক্ষ সাজিয়ে রেখেছে শিক্ষার্থীরাই। বিদ্যালয়ের পূর্ব দিকের পুরোনো টিনশেড ভবনটিকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে রেলগাড়ির আদলে। ভবনের ওপরে ‘কলকাকলি স্টেশন’ লেখা সাইনবোর্ড। রেলগাড়িটির নাম লেখা হয়েছে ‘জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেস’।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিলরুবা খাতুন বলেন, ‘বিদ্যালয় থেকে ঠিক কত দূর যাওয়া যায়, সে ভাবনায় মনে হয়েছে, মহাকাশই সবচেয়ে দূরের গন্তব্য। তাই রেলগাড়ির গন্তব্য সেটিই লেখা হয়েছে।’স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৭ সালে। তখনই পুরোনো এই ভবন নির্মিত। এর ওপরে টিন। পরিত্যক্ত ঘোষণা হলেও শ্রেণিকক্ষসংকটে এখানেই তিনটি কক্ষে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নেওয়া হয়। রং উঠে অনেক আগেই দেয়ালগুলো মলিন হয়ে যায়। এ নিয়ে বাচ্চাদের মন খারাপ হতো। তারা প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়ে বলে, সামনের দুটি ভবনে ছাদ আছে, তাদের নেই। তাদের শ্রেণিকক্ষগুলোও যেন সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে প্রধান শিক্ষক মিস্ত্রি ডেকে এনে রংতুলিতে করে ফেললেন জাপানি লেখক তেৎসুকো কুরোয়ানাগির তেত্তো-চান বইয়ের সেই রেলগাড়ি-ক্লাস! এখন তিনটি শ্রেণিকক্ষ যেন রেলগাড়ির একেকটি কামরা।
২০১০ সালে প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন দিলরুবা খাতুন। তিনি দেখেন, তিনটি ভবনের প্রতিটিই জরাজীর্ণ। শ্রেণিকক্ষের দেয়ালগুলো মলিন। ভিতরে শুধু ব্ল্যাকবোর্ড, আর চক-ডাস্টার। স্কুলের আঙিনায় বালু। গাছ নেই, ফুল নেই, সুন্দর পরিবেশ নেই। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কম। গ্রামের মানুষ স্কুলের ভবনে মই ভিড়িয়ে ছাদে ওঠে। ধান শুকাতে দেয়। স্কুলের আঙিনায় শুকাতে দেওয়া হয় পাট। দিলরুবা খাতুনের আপ্রাণ চেষ্টায় বদলে যায় সবকিছু।আগে স্কুলে টিফিনের সময়ই অনেক শিক্ষার্থী চলে যেত। প্রধান শিক্ষক তা বন্ধ করেন শিশুদের বুঝিয়ে। প্রতিবছরই পঞ্চম শ্রেণিতে চার-পাঁচজন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেতে শুরু করে। শূন্যে নামে ঝরে পড়ার হার। তাই ২০২২ সালে স্কুলটি জাতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পদক পায়। চলতি বছরেও বিভাগীয় পর্যায়ে এই প্রতিষ্ঠান শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছে।
২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটিশ কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। মাইক্রোসফট এডুকেশন প্রোগ্রামসের মাইক্রোসফট শোকেস স্কুলের তালিকাতেও রয়েছে এই স্কুল।শিশুরা আনন্দের সঙ্গেই এই স্কুলে আসে। প্রাক্-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতের লেখা শুরু করার জন্য প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারিতে এ স্কুলে ‘হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠান হয়। সেদিন স্কুলের আঙিনায় বসিয়ে শিশুদের প্রথম হাতের লেখা শেখানো হয়। তাদের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে রং, পেনসিল, খাতা, কলম, বিস্কুট ও চকলেট উপহার আসে। শিশুদের মায়েরা বাড়ি থেকে নানা ধরনের পিঠাপুলি বানিয়ে আনেন। এই পিঠা যেমন সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা খায়, তেমনি পিঠা খেতে আসেন গ্রামের সব বয়সী মানুষ। স্কুলে সেদিন উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।স্কুলটিতে ‘ভালো কাজের শিকল’ নামের একটি সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। বছরের শুরুতে স্কুলটির সব শিক্ষার্থীকে একটি করে নোটবুক দেওয়া হয়। প্রতিদিন কোন শিক্ষার্থী কী ভালো কাজ করেছে, তা এখানে লেখা হয়। তারপর প্রতি মাসে পড়ে শোনানো হয় শ্রেণিকক্ষে। যে শিক্ষার্থীর কাজগুলো সবচেয়ে বেশি ভালো মনে হয়, তাদের দেওয়া হয় ‘খুদে আলোকবর্তিকা’ লেখা ব্যাজ। এসব কার্যক্রমের কারণে আনন্দেই স্কুলে আসে শিক্ষার্থীরা।স্কুলের অনেক শিশুকেই কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন অভিভাবক। প্রধান শিক্ষক তাদের সহযোগিতার জন্য গঠন করেন দরিদ্র তহবিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক ড. আফরোজা খানম ও রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমকে যুক্ত করেছেন দাতা হিসেবে। প্রতিবছর এই তহবিলে তাঁরা ২০ হাজার করে টাকা দেন। সেই টাকায় ২০ জন করে শিক্ষার্থীকে সহযোগিতা করা হয়।