ঢাকা প্রেস
আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
‘মোর ৫ বিঘা জমিতে পটোল আবাদ করছিলং। এবারের দুই ধাপের বন্যায় সোগ নষ্ট হয়া গেইছে। অ্যাল্যাউ জমিত নয়া ফসল গাড়বের পাং নাই। সরকারে বীজ দিবার চাইছে, অ্যাল্যাউ দেয় নাই।’ কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছি ইউনিয়নের ছড়ার পাড় গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম। তিনি তাঁর জমিতে পটোলের সঙ্গে আবাদ করেছিলেন মরিচও। কিন্তু দুই দফা বন্যায় তাঁর প্রায় ৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি জানান।
সাইদুলের মতো জেলার প্রায় ৫০ হাজার কৃষক এখনও বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এখন সরকারি প্রণোদনার আশায় তারা দিন গুনছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত সে প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। সহায়তা না পেলে সংকটে পড়বেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী অনেক কৃষক।
রোববার কয়েকটি এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের ক্ষেত ঘুরে দেখা যায়, দুই দফা বন্যার পর এক মাস পার হলেও ক্ষত রয়ে গেছে। ক্ষেতে মরিচ, পাট, শসা, কাউন, পটোল, ঝিঙেসহ অনেক ফসলের গাছ নষ্ট হয়ে শুকিয়ে পড়ে আছে। চারপাশের ঘেরা দেওয়া বাঁশের বেড়াগুলো এলোমেলোভাবে রয়েছে। কেউ কেউ জমিতে আমন বীজতলা তৈরি করলেও অধিকাংশ জমি অনাবাদি পড়ে আছে।
কৃষকরা বলছেন, অনেকে ঋণ করে বীজ বপন করে বন্যায় সর্বস্ব হারিয়েছেন। জমানো বীজ রোপণ করে অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তারা বীজ, সার ও কীটনাশক কিনতে না পেরে নতুন করে ফসল উৎপাদন করতে পারছেন না। প্রণোদনা পেলে নতুন করে উৎপাদন শুরুর আশা তাদের। তারা জানান, প্রতি বিঘায় সার ও বীজ বাবদ ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। এর বিপরীতে ফসল বিক্রি করে লাভ আসে ৮০-৯০ হাজার টাকা।
পাঁচগাছির কলেজ মোড় এলাকার কৃষক ফারুক হোসেনের বীজতলা বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে। এখন উঁচু এলাকায় অনেকে চড়া দামে বীজতলা বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, এখন বেশি খরচ করে বীজতলা করলেও আবার বন্যা হলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। এর আগে পানিতে তলিয়ে সবজি নষ্ট হয়েছে। একই এলাকার শামসুল আলমের ভাষ্য, ‘আমি চার বিঘায় মরিচ আর শসা আবাদ করেছিলাম। বন্যায় সব শেষ। এক মাস ধরে কামলা দিয়ে চলছি। নতুন করে চাষাবাদ শুরু করতে পারিনি।’
সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের ধরলার পাড়ের কৃষক মো. রব্বানী দুই বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে সেগুলো কাটা হতো। এর মধ্যে বন্যায় তলিয়ে সব গাছ মরে গেছে। এখন জ্বালানি করা ছাড়া উপায় নেই জানিয়ে তিনি বলেন, পাট কেটে খড়ির জন্য শুকাচ্ছেন। এখনও কোনো সহযোগিতা পাননি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও জিঞ্জিরামসহ ১৬ নদনদীর জেলা কুড়িগ্রাম। এ জেলায় বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। চলতি বছর খরা, অতিবৃষ্টি ও বন্যায় কৃষির ক্ষতি হয়েছে। পাট, আমন বীজতলা, শাকসবজি, আউশসহ বিভিন্ন ফসলের হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এবার এপ্রিল ও মে মাসে বৃষ্টিও হয়নি। এর পর জুনে অতিবৃষ্টি হয়েছে। এ সময় ১ হাজার ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে কৃষি আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে।
জুলাইয়ের প্রথম থেকে শুরু হয়েছিল বন্যা। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা সম্বল হারিয়ে নতুন করে ফসল উৎপাদন করতে পারছেন না। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বন্যায় ৯ উপজেলায় আট হাজার হেক্টর জমির বিভিন্ন ধরনের ফসল নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১০৫ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা অন্তত ৫০ হাজার।
যাত্রাপুরের কৃষক মমিন মিয়ার ভাষ্য, তাঁর জমি ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নিচু অঞ্চলে হওয়ায় বন্যার পানিতে বীজতলাসহ সব নষ্ট হয়ে গেছে। হাতে টাকাও নেই। ঋণ করে আমন চারা রোপণ করা ছাড়া উপায় নেই তাঁর। এ ইউনিয়নের প্রায় পুরোটাই চরাঞ্চল জানিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল গফুর বলেন, এলাকার প্রায় সব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের বীজসহ সার-কীটনাশক দিয়ে সহায়তা প্রয়োজন। না হলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মামুনুর রহমান বলেন, দুই দফায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এখনও বরাদ্দ আসেনি। সরকারি প্রণোদনা পেলে তা কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হবে।