বাজেটের পর ঢাকার শেয়ারবাজারে বড়পতন

প্রকাশকালঃ ১১ জুন ২০২৪ ০৩:৪৯ অপরাহ্ণ ৩৯৭ বার পঠিত
বাজেটের পর ঢাকার শেয়ারবাজারে বড়পতন

ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১২টা ছুঁইছুঁই। রাজধানীর মতিঝিলে গতকাল দেশের শীর্ষ একটি ব্রোকারেজ হাউজে তখন অনেকটা সুনসান নীরবতা। এক পাশে তিন-চার জন বিনিয়োগকারী বসে আছেন। তাদের মুখেও কথা নেই। অথচ এই হাউজেই কয়েক বছর আগেও বিনিয়োগকারীদের পদচারণায় মুখরিত থাকত। এই হাউজেই গতকাল কথা হলো ষাটোর্ধ একজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে। বাজার সম্পর্কে জিগ্যেস করতেই অনেকটা হতাশার সুরে তিনি জানালেন, ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি শেয়ার বাজারে আছেন।

 

কিন্তু এমন খারাপ সময় তিনি দেখেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই বিনিয়োগকারী বলেন, ‘আগে বাজার খারাপ হলেও কিছুদিনের মধ্যেই আবার ঘুরে দাঁড়াত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বাজার খারাপ যাচ্ছে’। তিনি বলেন, ‘দিনে দিনে বাজার খারাপ হতে হতে একদম খাদের কিনারে এসে ঠেকেছে। আমাদের ঈদ নেই, কোনো উত্সব নেই। ভেবেছিলাম, বাজেটে এমন কিছু থাকবে, যাতে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু বাজেট পেশের পর বাজার যেন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।’


দেশের প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক একচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল সোমবারও মূল্যসূচকের বড়পতন হয়েছে। এদিন এই বাজারে লেনদেনকৃত মোট ৩৯১টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র ২৬টির। আর দর কমেছে ৩৪২টি কোম্পানির। অর্থাৎ, লেনদেনকৃত মোট কোম্পানির মধ্যে ৮৭ শতাংশেরই দর কমেছে। আর মাত্র ২৩টি কোম্পানির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬৫.৭৬ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ১০৫.৮৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে। আগের দিনও প্রধান সূচকটি ৬৫ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট কমেছে।

 

এতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশের পর গত দুই কার্যদিবসে ডিএসইএক্স ১৩১ পয়েন্টের বেশি কমেছে। এতে ডিএসইর প্রধান সূচকটি ২০২১ সালের ৪ এপ্রিলের পর সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে এসেছে। ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর ডিএসইর প্রধান সূচক ৫ হাজার ৮৯ পয়েন্ট ছিল। এদিন এই বাজারে ৩১৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৩৫৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সে হিসাবে লেনদেন কমেছে ৩৮ কোটি ১২ লাখ টাকা। অন্য বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ১৬২ পয়েন্ট।

 

বাজার বিশ্লেষকরা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশের শেয়ার বাজারে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। বিনিয়োগকারীরা আশা করছিলেন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারে গতি ফেরাতে বিভিন্ন প্রণোদনা থাকবে। কিন্তু তা-তো নেই-ই উলটো মূলধনি মুনাফার ওপর কর আরোপ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজারে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা ৫০ লাখ টাকার ওপরে ক্যাপিটাল গেইন করলে তার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ট্যাক্স দিতে হবে। যেটা আগে ছিল না। এছাড়া, আগামী অর্থবছর থেকে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমছে।

 

শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির জন্য এই হার ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো, একক লেনদেনে ৫ লাখ টাকা এবং বার্ষিক সর্বমোট ৩৬ লাখ টাকার বেশি সব খরচ ও বিনিয়োগ ব্যাংকের মাধ্যমে হতে হবে। বর্তমানে এই শ্রেণির প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ২৭ শতাংশ কর দিতে হয়। এছাড়া, শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে করপোরেট কর আগের মতোই ২০ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। শর্ত পূরণ না করলে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে এ করহার হবে সাড়ে ২২ শতাংশ। এ হিসেবে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে কর হারের ব্যবধান আরো কমেছে।

 

ফলে বিনিয়োগকারীরা বাজার নিয়ে অনেকটা হতাশ। যার কারণে বাজেট পেশের পর গত দুই কার্যদিবসে সূচকের এ বড়পতন। সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি)  সাবেক চেয়ারম্যান ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আগামী বাজেটে শেয়ার বাজার নিয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। কিন্তু বর্তমান মন্দাবস্থায় শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ঘোষণা করা উচিত ছিল।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের শীর্ষ একটি ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী এ প্রসঙ্গে গতকাল বলেন, আজকে বাজারের এ মন্দাবস্থা এক দিনে হয়নি। ধীরে ধীরে বাজার এ অবস্থায় এসেছে। তিনি বলেন, শেয়ার বাজারের মূল সমস্যা কি? তা আসলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) বুঝতে পারছে না। তিনি বলেন, আমার হয়েছে জ্বর, আর আমাকে দেওয়া হয়েছে পেট খারাপের ওষুধ। তাহলে কি আমার রোগ ভালো হবে? তিনি আক্ষেপ করে বলেন, শেয়ার বাজারের মূল মার্কেট যেখানে চলে না, সেখানে বিএসইসি এসএমই মার্কেট নিয়ে ব্যস্ত। অথচ এসএমই মার্কেটে কয়টা ভালো কোম্পানি আনা হচ্ছে? এসব কিছু এখন রিভিউ করতে হবে।