বংশগত রোগ থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা

প্রকাশকালঃ ০৮ মে ২০২৩ ০১:৫৮ অপরাহ্ণ ১০২ বার পঠিত
বংশগত রোগ থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা

থ্যালাসেমিয়া রক্তের একটি মারাত্মক বংশগত রোগ। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য থ্যালাসেমিয়া একটি গুরুতর সমস্যা। কারণ দেশে শতকরা ৮-১০ ভাগ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক; কিন্তু বেশির ভাগই এ বিষয়ে অজ্ঞ। প্রায় দেড় কোটি মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের জিন বহন করছে এবং তা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়ার জিন নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। এ অবস্থা বিরাজ করলে ভবিষ্যতে থ্যালাসেমিয়ার একটি ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে।     

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ ৮ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস-২০২৩। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হচ্ছে—‘BE AWARE. SHARE. CARE.: Strengthening Education to Bridge the Thalassaemia Care Gap। থ্যালাসেমিয়া রোগী, বাহক ও সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, চিকিত্সা ব্যবস্থাপনা জোরদার এবং চিকিত্সাসেবায় নিয়োজিতদের অনুপ্রেরণার মাধ্যমে জীবনমান উন্নত করাই এ দিবসের মূল লক্ষ্য। ১৯৯৪ সালে প্রথম বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস (World Thalassemia Day) পালিত হয়। থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন প্রথম ৮ মে-কে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস হিসেবে পালন করতে বলেন। ওই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাইপ্রাসের প্যানোস এনগ্লেজোসের (Panos Englezos) সন্তান জর্জ এনগ্লেজোস (George Englezos) থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। তাঁর স্মরণে এবং বাকি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের স্মরণে এই দিনটি পালন করা শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি থ্যালাসেমিয়া রোধে সচেতনতা প্রসারের কাজও শুরু করা হয়। 

থ্যালাসেমিয়া কথাটির অর্থ রক্তের সমুদ্র। গ্রিক শব্দ thalassa (অর্থ সমুদ্র) এবং aemia (অর্থ রক্ত) শব্দ থেকে থ্যালাসেমিয়া রোগের নামকরণ। রক্তের এ রোগ সর্বপ্রথম ১৯২৫ সালের দিকে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় শনাক্ত হয়েছিল বলেই এরূপ নামকরণ, পরে ১৯৪৬ সালে এ রোগের কারণ আবিষ্কৃত হয়। এ রোগের শুরুটা মূলত এশিয়া ও আফ্রিকার ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায়। এসব অঞ্চলে মহামারি আকারে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের কারণে মানুষের মধ্যে জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন উত্পাদনের জিনে ত্রুটির সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে উত্তরাধিকার হিসেবে এ জিনগত ত্রুটি প্রজন্মের পর প্রজন্মে অনুপ্রবেশ করেছে। ক্রমান্বয়ে বিশ্বায়ন, মাইগ্রেশন ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে এটি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছে। বিশ্বে প্রতিবছর থ্যালাসেমিয়ার জিনগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুর ৮০ শতাংশের জন্ম উন্নয়নশীল দেশে। বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ১.৫ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়া মাইনর রোগে আক্রান্ত অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়া বাহক। থ্যালাসেমিয়া মেজর নিয়ে বেঁচে আছে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রে বিটা থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসায় আক্রান্তের জীবদ্দশায় খরচ হয় প্রায় 

৫০ হাজার ডলার। বংশগত এ রোগের চিকিৎসায় আরব বিশ্বে বছরে খরচ হয় প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। বেঁচে থাকলেও এসব রোগাক্রান্তদের গড় আয়ুষ্কাল ৪০ বছর। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজির তথ্য মতে, বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগীর সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ হাজার। 

আমাদের শরীরে রক্তের অন্যতম প্রধান কাজ শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া। রক্তের এই অক্সিজেন পরিবহনের কাজটি সম্পাদন করে থাকে রক্তের লোহিত কণিকায় অবস্থিত হিমোগ্লোবিন নামের রঞ্জক পদার্থ। হিমোগ্লোবিন হচ্ছে একটি আয়রনসমৃদ্ধ প্রোটিন, যা তৈরি হয় দুটি আলফা প্রোটিন ও দুটি বেটা প্রোটিন দিয়ে। এ দুই প্রকার হিমোগ্লোবিন চেইনের সংশ্লেষণ মূলত বংশানুক্রমে বা জিনগতভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। যদি এই প্রোটিনগুলোর উৎপাদন শরীরে কমে যায়, তবে শরীরের হিমোগ্লোবিনের উৎপাদনও কমে যায় এবং থ্যালাসেমিয়া দেখা দেয়।   

থ্যালাসেমিয়া রোগটি বংশানুক্রমিক। মানে, রোগটা আসে মা ও বাবার জিন থেকে। যখন স্বামী ও স্ত্রী দুজনই বাহক হয় তখন তাঁদের প্রতিটা সন্তানের ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ২৫ শতাংশ। আর যদি একজন রোগী ও অপরজন বাহক হয়, তাহলে এ সম্ভাবনা দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ। উভয়েই রোগী হলে তাঁদের প্রতিটা সন্তানই রোগী হবে। তবে স্বামী ও স্ত্রীর একজন বাহক ও একজন সুস্থ হলে তাঁদের সন্তানদের কেউই এই রোগে আক্রান্ত হবে না, যদিও তাঁদের সন্তানদের বাহক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫০ শতাংশ । 


থ্যালাসেমিয়া সাধারণত দুই প্রকারের হয়। যেমন—আলফা থ্যালাসেমিয়া বা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (thalassemia minor) এবং বেটা থ্যালাসেমিয়া বা থ্যালাসেমিয়া মেজর (thalassemia major)। থ্যালাসেমিয়া মাইনর রোগীর দেহে কম রক্তকণিকা উত্পন্ন হলেও তাদের কোনো লক্ষণ বা জটিলতা দেখা দেয় না, কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। বেশির ভাগ রোগী জানেও না তাদের দেহে এ রোগ বাহক হিসেবে আছে। বেটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি; ঠিকমতো চিকিত্সা না করলে অল্প বয়সেই রোগীর মৃত্যু হতে পারে।   

মানুষের দেহের রক্তের লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল তিন মাস। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর দেহে হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ায় লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায় এবং আয়ুষ্কাল অনেক কমে যায়। অস্থিমজ্জার পক্ষে একই হারে লোহিত কণিকা তৈরি সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে তাদের দেহে রক্তশূন্যতা সৃষ্টি হয়, অস্থিমজ্জা প্রসারিত হয়ে যায় এবং হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন দেহ থেকে বের করার কাজে নিয়োজিত প্লিহার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ার কারণে আয়তনে বেড়ে যায়। থ্যালাসেমিয়া হলে, বিশেষ করে বেটা থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নানা রকম লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যায়, যেমন—অবসাদ অনুভব, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মুখমণ্ডল ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, অস্বস্তি, ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস), মুখের হাড়ের বিকৃতি, ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি, পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া, গাঢ় রঙের প্রস্রাব ইত্যাদি। থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের বেশির ভাগের বেঁচে থাকা রক্ত পরিসঞ্চালনের ওপর নির্ভরশীল। দীর্ঘ পরিসঞ্চালনজনিত কারণে হৃপিণ্ড, অগ্ন্যাশয়, যকৃত্, অণ্ডকোষ ইত্যাদি অঙ্গের কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। ফলে ডায়াবেটিস, লিভার সিরোসিস দেখা দিতে পারে। 

থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা আলফা কিংবা মৃদু থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে লক্ষণ ও উপসর্গ খুব কম এবং অনেক ক্ষেত্রে চিকিত্সার প্রয়োজন হয় না বা খুবই অল্প চিকিত্সার প্রয়োজন হয়। তবে মাঝারি থেকে মারাত্মক থ্যালাসেমিয়ার বা বেটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে বছরে আট থেকে ১০ বার রক্ত দেওয়া প্রয়োজন হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন (Bone Marrow transplant) করার প্রয়োজন হয় এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়। 


কারো রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ যদি কম থাকে এবং উপরোক্ত লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তের পরীক্ষা করিয়ে তার থ্যালাসেমিয়া আছে কি না নিশ্চিত হতে হবে; মাইনর নাকি মেজর সেটাও নিশ্চিত হতে হবে। রক্তের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস থ্যালাসেমিয়া শনাক্তকরণের জন্য সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত। 

মারাত্মক এই ব্যাধি প্রতিরোধই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, দেশের স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোতে থ্যালাসেমিয়া সেন্টার বা কর্নার স্থাপন করতে হবে। তৃতীয়ত, বিয়ে সংশ্লিষ্ট পাত্র-পাত্রীদের থ্যালাসেমিয়ার পরীক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক বা রোগীর সঙ্গে আরেকজন বাহক বা রোগীর বিবাহ নিরুত্সাহে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশেও এই মারাত্মক রোগ প্রতিরোধে এ ধরনের আইন প্রণয়ন ও জনগণকে এ বিষয়ে ব্যাপক সম্পৃক্ত করতে হবে। 

সচেতনতাই পারে থ্যালাসেমিয়া রোগী ও বাহকদের উন্নত জীবন যাপনে সহায়তা করতে এবং থ্যালাসেমিয়া মুক্ত পরিবার, সমাজ ও দেশ এবং সর্বোপরি একটি সুস্থ পৃথিবী বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে।


লেখক : এমফিল, এমপিএইচ, প্রেষণে কুয়েতে নিযুক্ত 
nazmul29@yahoo.com