বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্যসংকটে ভুগছে পানিবন্দি মানুষ

প্রকাশকালঃ ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ ৪৮৮ বার পঠিত
বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্যসংকটে ভুগছে পানিবন্দি মানুষ

বৃষ্টির কারণে দেশের বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর বেশির ভাগের পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। পানিতে ঘরবন্দি কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষও খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছে। গো-খাদ্যেরও সংকট চলছে। শেরপুরে ঢলের কারণে দুই সহোদরসহ আরো তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।

 

ময়মনসিংহ

বন্যায় পানিবন্দি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার বাসিন্দারা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় নৌকার অভাবেও দুর্দশায় পড়েছেন। বিদ্যুৎ সংযোগ ও ইন্টারনেট না থাকায় অনেকে তাদের দুরবস্থার কথা প্রশাসন কিংবা দূরের আত্মীয়-স্বজনকেও জানাতে পারছে না। গতকাল রবিবারও এই দুই উপজেলায় ভারি বৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, নিতাই, দর্শা, গাংগিনা, লালা, কংশসহ বেশ কিছু নদ-নদীর পানি উপচে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

 

এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে নতুন নতুন এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। উভয় উপজেলার সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয়ণকেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেনাবাহিনী এবং একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পানিবন্দি মানুষের উদ্ধারে কাজ করছে। তবে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম বেশ দুর্বল বলে জানা গেছে।


বিদ্যুৎ সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে  জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। হালুয়াঘাট মকিমপুর নগুয়া কান্দাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমার এলাকায় প্রায় ৬০টি পরিবার, সবার ঘরে পানি। অনেকে নৌকার অভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারছে না। আমার এলাকায় এখন পর্যন্ত ত্রাণ নিয়ে কেউ আসেনি।’

 

কুতুরা গ্রামের আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দা আব্দুল খালেক বলেন, ‘ঘরে থাকা চাল-ডাল নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা এখনো সরকারি কোনো সাহায্য পাইনি।’ হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদুল আহমেদ বলেন, ‘জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মাধ্যমে আমরা যে বরাদ্দ পেয়েছি, তা দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

 

শেরপুর

নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের পর এবার নকলা ও শেরপুর সদর উপজেলার আটটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে নতুন করে ঢলের পানি প্রবেশ করেছে। বন্যাকবলিত প্রায় দুই লাখ মানুষ। বৃষ্টি থাকায় গতকালও ভোগাই নদীর পানি নাকুগাঁও পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে ছিল।

 

পাহাড়ি ঢলে দুই সহোদরসহ আরো তিনজনের মৃত্যু ঘটেছে। নালিতাবাড়ীতে ঢলের স্রোতে নিখোঁজ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর শনিবার সন্ধ্যায় নন্নীর কুতুবাকুড়া এলাকায় ধানক্ষেত থেকে হাতেম (৩২) ও আলমগীর  (১৮) নামের দুই ভাইয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়।

 

এ ছাড়া নকলার উরফা ইউনিয়নের কুড়েরকান্দা গ্রামের মুক্তার হোসেন (৫০) কলার ভেলায় করে উঁচু স্থানে যাওয়ার সময় বিদ্যুত্স্পর্শে মারা গেছেন। এ নিয়ে চলতি পাহাড়ি ঢলে জেলায় ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটল। এখনো নিখোঁজ রয়েছে তিনজন।ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা।

 

নেত্রকোনা 

সোমেশ্বরী, কংস ও উব্দাখালী নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত জেলার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের অন্তত ১০৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার বেশ কিছু গ্রামীণ সড়ক ঢলের পানিতে ডুবে গেছে।জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, পূর্বধলা ও সদর উপজেলায় ১৮৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্লাবিত হওয়ায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

 

পাহাড়ি ঢলে দুর্গাপুরের সাত ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচ ইউনিয়নের ৪০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, উপজেলার ১৬ হাজার ৪০০ হেক্টর জমির মধ্যে কুল্লাগড়া, কাকৈরগড়া, চণ্ডিগড় ও গাঁওকান্দিয়া ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।

 

দুর্গাপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি অফিসার নিপা বিশ্বাস বলেন, ‘পানি যদি কমে যায় তাহলে আশা করি কৃষকরা রক্ষা পাবেন। কিন্তু যেভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে যদি চার থেকে পাঁচ দিন এভাবেই পানিতে তলিয়ে থাকে, তাহলে সব ফসল নষ্ট হয়ে যাবে।’

 

কলমাকান্দা উপজেলার উব্দাখালী, মহাদেও, গনেশ্বরী, মঙ্গলেশ্বরী, বৈঠাখালী, মহেষখলা নদী ও পাঁচগাঁও ছড়ার পানি বেড়েই চলেছে। কলমাকান্দা সদর, রংছাতি, খারনৈ, লেংগুরা, নাজিরপুর—এই পাঁচটি ইউনিয়নের বেশ কিছু সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। অর্ধশত গ্রামের অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি।

 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, চলতি বছর ১৫ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আমন ধান ও ৩০০ হেক্টর জমিতে শাক-সবজি রোপণ করা হয়েছিল। তার মধ্যে প্রায় আট হাজার হেক্টর আমন ধান ও ৭০ হেক্টর শাক-সবজি পানিতে তলিয়ে গেছে।

 

সুনামগঞ্জ 

মধ্যনগর উপজেলার বংশীকুণ্ডা উত্তর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী ২৫ থেকে ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে কয়েক হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। গতকাল সকালে মহিষখলা ছরা ও সোমেশ্বরী নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে বেশির ভাগ গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলের মাঠও তলিয়ে গেছে।

 

মহিষখলা বাজারের ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র ঘোষ জানান, সকালে হঠাৎ করেই ঢলের পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে। মহিষখলা বাজার পুরোটাই প্লাবিত হয়েছে। অনেকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে মালপত্র নষ্ট হয়ে গেছে।

 

কুড়িগ্রাম 

দুই দিন ধরে ভারি বৃষ্টি ও উজানের ঢলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বর, ফায়ার সার্ভিস চত্বর, টাপু ভেলাকোপা, চর হরিকেশ, তালতলা  ও রৌমারীপাড়ার কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত। রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক সুবল চন্দ্র রায় জানান, গত দুই দিনের মতো ভারি বৃষ্টি না হলেও সপ্তাহজুড়ে থেমে থেমে বৃষ্টি হবে। 

 

নোয়াখালী 

শনিবারের টানা বৃষ্টিতে আবারও নোয়াখালীর বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গতকাল বৃষ্টি না হলেও জেলা শহরের বেশির ভাগ সরকারি বেসরকারি অফিসের সামনে এবং প্রধান সড়কসহ সংযোগ সড়কগুলোতে জলাবদ্ধতা আছে।

 

গতকাল জেলা শহর মাইজদীর লক্ষ্মীনারায়ণপুর, হরিণারায়ণপুর ও বিশ্বনাথ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ওই সব এলাকার অনেক সড়ক ডুবে গেছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে রেড ক্রিসেন্ট, প্রেস ক্লাব, জেলা জজ আদালত চত্বর ও সামনের সড়ক। লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা নুরুল হক জানান, রান্না ঘরে পানি, তাই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেননি। বাচ্চাদের নিয়ে চরম ভোগান্তিতে আছেন।

 

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানায়, ড্রেনেজব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই সড়কে পানি জমে যায়। পানির কারণে দোকানে ক্রেতারা আসতে চায় না। বাসিন্দাদের ভোগান্তি দূর করার কথা সবাই বলে। কিন্তু কাজের কাজ কেউ করে না। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জাহিদ হাসান খান জানান, বেগমগঞ্জ উপজেলায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষ এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে। কারণ উপজেলাটির কিছু এলাকায় এখনো বাড়িতে পানি রয়েছে।