প্রকাশকালঃ
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:০৫ অপরাহ্ণ ২৮৬ বার পঠিত
১৩ বছর আগের কথা। ‘প্রকৃতিনির্ভর রিসোর্ট’বিষয়ক এক প্রতিযোগিতার বিচারক হয়ে নড়াইলের পানিপাড়া গ্রামে গেলাম রিসোর্ট পরিদর্শনে। মধুমতী নদীর পাড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে এটি তৈরি করা হয়েছে। রিসোর্টের পুকুর-লেক-বাগানে সব সময় পাখির মেলা! ওখানকার পদ্মপুকুর, আমবাগান ও কৃত্রিম দ্বীপগুলো অত্যন্ত সুন্দর। রিসোর্টটি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। প্রকৃতি ও পাখির ছবি তুলতে তুলতে লেকের পাড়ের ফুলবাগানে ঢুকলাম। ফুলে ফুলে যেন প্রজাপতির মেলা! বেশ মনোযোগ দিয়ে ছবি তুলছিলাম।
ঢাকায় এসে ল্যাপটপে আপলোড করতেই একটি ছবিতে চোখ আটকে গেল। কমলা ডানার ওপর নীল কালো ছোপ ও গোল গোল চোখের মতো চক্র দেখে ছেলেবেলার ঘটনা মনে পড়ে গেল। তখন চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন বাসার পাশে এ রকম একটি মরা প্রজাপতি পড়ে থাকতে দেখে আগ্রহের সঙ্গে হাতে তুলে নিলাম। কাগজের ছোট বাক্স কেটে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে মুড়িয়ে নিলাম। একপাশে প্লাস্টিক দিয়ে জানালা তৈরি করলাম, যাতে প্রজাপতিটিকে দেখা যায়। পরে এভাবে আরও কয়েকটি মরা প্রজাপতি সংরক্ষণ করেছিলাম। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে পড়াশোনার চাপে এ কাজ আর এগোল না।
যাহোক প্রজাপতির মতো এত সুন্দর পতঙ্গ সম্ভবত পৃথিবীতে আর নেই। কল্পনায় যত রং আঁকা যায়, তত রঙেরই প্রজাপতি থাকা সম্ভব। বাহারি কারুকাজযুক্ত রঙিন ডানাওয়ালা পতঙ্গগুলো অ্যান্টার্কটিকা বাদে পৃথিবীর সবখানেই রয়েছে। প্রজাপতি লেপিডপটেরা বর্গভুক্ত, গ্রিক ভাষায় যার অর্থ আঁশযুক্ত ডানাওয়ালা পতঙ্গ। এ বর্গে আরও রয়েছে মথ। আনুমানিক ২০ কোটি বছর আগে ওদের উদ্ভব হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী ১৫-২০ হাজার প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৪৩০টি প্রজাতি তালিকাভুক্ত হলেও মোট প্রজাতি সংখ্যা পাঁচ শতাধিক হতে পারে।
প্রজাপতিকে সচরাচর পরিবর্তন, আনন্দ, ভালোবাসা ও রূপান্তরের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। তবে ওরা প্রকৃতির সুস্থতারও নির্ণায়ক। ওরা সচরাচর দিনে ফুলে ফুলে উড়ে রস পান করে। ফুলের পরাগায়ন ও গাছের বংশবিস্তারে সাহায্য করে। জীবনচক্র ডিম, শূককীট, মুককীট ও পূর্ণাঙ্গ পতঙ্গ—চার পর্বে বিভক্ত। প্রজাপতি দেখতে যতটা সুন্দর শূককীটগুলো কিন্তু মোটেও তেমন নয়। তা ছাড়া ওরা গাছের বেশ ক্ষতি করে। অবশ্য কোনো কোনো প্রজাতির শূককীট ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে কৃষকদের উপকারও করে। শূককীট অনেক পাখির প্রিয় খাদ্য, তাই পাখিরাও প্রজাপতির ওপর কিছুটা নির্ভরশীল।
পাপুয়া নিউগিনির ‘রানি আলেকজান্দ্রার বিহন’ বিশ্বের বৃহত্তম প্রজাপতি, যার প্রসারিত ডানা ২৫০ থেকে ২৮০ মিলিমিটার। আর উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকার ‘পশ্চিমা বামন নীল’ বিশ্বের ক্ষুদ্রতম প্রজাপতি (প্রসারিত ডানা ১০ মিলিমিটার)। ‘বেণুবিহন’ বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রজাপতি (প্রসারিত ডানা ১৪০ থেকে ১৯০ মিলিমিটার) ও ‘সলমা’ ক্ষুদ্রতম (প্রসারিত ডানা ২০ থেকে ২২ মিলিমিটার)। বিশ্বব্যাপী বহু সুন্দর সুন্দর প্রজাপতি ও মথ রয়েছে, যেমন নীল প্রজাপতি, স্বচ্ছ প্রজাপতি, ৮৮ প্রজাপতি ইত্যাদি। এসব প্রজাপতি বা ওদের নিকটাত্মীয় কিছু প্রজাতি এ দেশেও রয়েছে। যেমন বেণুবিহন, শ্বেতফড়িংলেজি, তিতিমৌরল, মরা পাতা ইত্যাদি। অন্যান্য সুন্দর প্রজাপতির মধ্যে রয়েছে গর্দাপেয়ারী, নিশি সিন্ধুপ, রত্নচূড়, চোরকাঁটা কমলা, নীল শিখীপর্ণ, বিদূষক ইত্যাদি।
আমাদের দেশের প্রজাপতির মধ্যে সচরাচর যেগুলোকে দেশজুড়ে দেখা যায়, তার মধ্যে উদয়াবল্লী, সাত ডোরা, নীরদ সিন্ধু, মনমেঘা, কস্তুরি শার্দূল, নীল ডোরা, চোরকাঁটা কমলা, উষসী বায়স, নীল পুনম, অংশুচপল, কমলা শিখীপর্ণ, ধূসর শিখীপর্ণ, বনবেদে, নাবিক, কৃষ্ণতরঙ্গ, গুণনকর বনপাল, কুম্ভীধনু, তৃণাঙ্গুরী, উষসী কপিল, ভোল ভ্রামরী, রাগ নকশি, হেমশুভ্র, চৈতালি দূত, তৃণ গোধুম, তৃণ বিদূষক, তিলাইয়া, কৃষ্ণতিলা, পঞ্চতিলা, তিন্নি, নীলবিজুড়ী, মলয় মশাল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
প্রজাপতি দেখে মুগ্ধ হলেও আমাদের কজনই-বা ওদের সঠিক পরিচয় ও উপকারিতা সম্পর্কে জানি? তা ছাড়া প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় উদ্ভিদ, পাখি ও বন্য প্রাণীর মতো প্রজাপতিরও যে ভূমিকা রয়েছে, তা-ও অনেকেরই অজানা। সে জন্যই ওদের সংরক্ষণের ব্যাপারে আমরা ততটা সচেতন নই। এ দেশে বর্তমানে কত প্রজাতির প্রজাপতি বিলুপ্তির দোরগোড়ায় ও কয়েকটি এরই মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। আমাদের প্রাকৃতিক গাছগুলোকে সংরক্ষণ করে প্রজাপতি সংরক্ষণ করা সম্ভব।