বৃষ্টি মানে তুমি

  প্রিন্ট করুন   প্রকাশকালঃ ২৩ মে ২০২৫ ১২:২৭ পূর্বাহ্ণ   |   ৫১ বার পঠিত
বৃষ্টি মানে তুমি

ঢাকা প্রেস-নিউজ ডেস্ক:-

 

লেখা: মাহাবুবা লাকী! 

তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হলো নিরুপমা। পল্টন ব্রিজের নিচ থেকে কিছু দরকারি বই কিনে এক বন্ধুর কাছে পৌঁছে দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ এমন এক মেঘলা, বৃষ্টিভেজা দিনে একচুলও বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু কী আর করা, নোটের কিছু কোটেশন দরকার—এই কাজটা জরুরি।

নিরুপমার জীবন বরাবরই একটু অগোছালো। কোনো কাজ নিয়মমাফিক চলে না। আর যেটুকু শুরু হয়, সেটাও যেন বিপদের ঘনঘটা নিয়েই আসে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।

বেরোনোর পরেই এক পশলা বৃষ্টি নেমে এল, থমকে দিল জনজীবন। নিরুপমা দেখল, রাস্তার দুই পাশে সুনসান নীরবতা—না রিকশা, না গাড়ি, শুধু পুলিশের দল দাঁড়িয়ে আছে মোটা লাঠি হাতে। তাদের কাজ এখন রিকশাগুলোর লাইসেন্স বাতিল করা। খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এ এক নির্মম পরিস্থিতি। নিরুপমা এগিয়ে গিয়ে কারণ জানার চেষ্টা করল, কিন্তু পুলিশদের চোখে মুখে কঠিনতা—কোনো সদুত্তর মেলেনি।

ঠিক তখনই এক যুবককে চোখে পড়ল—টি-শার্ট, কোর্ট, বুট পরা স্মার্ট চেহারার একজন মানুষ। আশেপাশে সবাই উদ্বিগ্ন, ত্রস্ত, আর সে? দিব্যি দাঁড়িয়ে পুলিশের কার্যক্রম দেখছে। নিরুপমা এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইল, "সব রাস্তায় তো রিকশা চলছে, শুধু কোর্টের সামনেই কেনো বন্ধ?"

যুবকটি এমনভাবে তাকাল যেন নিরুপমা তার হৃদপিণ্ড চেয়ে বসেছে। নিরুপমা বিরক্ত হয়ে সরে এল।

একটা অটোরিকশা ডেকে জিজ্ঞেস করল, "মামা, বাংলামটর হয়ে টি.এস.সি যাবেন?" মামা বললেন, যাবেন, কিন্তু কথায় আশ্বস্ত হওয়া গেল না।

ঠিক তখনই সেই যুবকটি এগিয়ে এল। আমায় অনুসরণ করেই জানতে চাইল, "বাংলামটর হয়ে যাওয়া যাবে?"

যন্ত্রণা আর হাহাকারের মাঝেও তার কণ্ঠে ছিল ভরসার খোঁজ। নিরুপমার মনে একরকম মায়া জেগে উঠল। বলল, "হ্যাঁ, যাওয়া যাবে। তবে শাহবাগে নেমে হাঁটতে হতে পারে।"

যুবকটি বিস্মিত চোখে চেয়ে বলল, "আপনি নিশ্চয়ই বাংলার ছাত্রী?" নিরুপমা মাথা ঝাঁকালো। সে হেসে বলল, "তাহলে আপনার বাড়ি না পেলে আপনার পিছু পিছু যাবো!"

অবাক হয়ে গেল নিরুপমা। এমন তো কথা বলার কথা ছিল না! তবে সে আর কিছু না বলে অটোতে উঠে পড়ল, যুবকটিও সঙ্গে।

রাস্তা ভীষণ জ্যাম। চারপাশে উৎসবমুখর পরিবেশ, টি-শার্ট পরা তরুণ-তরুণীদের মিছিল। যুবকটি আগ্রহ নিয়ে সব কিছু দেখছে। হঠাৎ বলল, "এরা কারা?"

নিরুপমা বলল, "সবাই আমার বাবার বাড়ির লোক!"—ব্যঙ্গ করে। সে আবার বলল, "তাই নাকি! বাহ!"

এইভাবে গল্প এগোতে থাকে। মগবাজারে পৌঁছে যুবকটি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, "আর কতক্ষণ লাগবে?"

নিরুপমা ঝাঁঝালো গলায় বলে, "Can you please shut up?" এবং অটোওয়ালাকে থামতে বলে। যুবকটি অস্থির, শিশুর মতো প্রশ্ন করে। নিরুপমা রাগে ফেটে পড়ে।

এক ফাঁকা অটো পেয়ে দুইজন ছুটে যায়, ধাক্কাধাক্কিতে যুবকের পায়ে চোট লাগে। সে ব্যথায় কুঁকড়ে যায়, কিন্তু নিরুপমা তখনো রাগে টগবগ করছে। তবুও একটা গাড়ি পেয়ে দু’জনে উঠে পড়ে।

শাহবাগের সামনে নেমে নিরুপমা একা ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে শুরু করে। হঠাৎ টের পায়, যুবকটি পাশে পাশে হাঁটছে। বলল, "আপনি কেনো পিছু নিয়েছেন?"

যুবকটি শান্তভাবে বলল, "বিশ্ববিদ্যালয়টা দেখতে চাই।" নিরুপমা বিরক্ত হলেও, যুবকের সম্মানজনক ব্যবহার তার মনে এক ধরনের প্রশান্তি এনে দেয়। সে বুঝে, ছেলেটি স্পর্শ না করেই তাকে রক্ষা করছে আশেপাশের ভিড় থেকে।

একটা অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করে নিরুপমার মনে। যেন হঠাৎ নিজেকে ‘মেঘবালিকা’ মনে হয়। মনে হয় রাজা নিজেই রাজকন্যাকে ভীড় ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট বন্ধ দেখে মুষড়ে পড়ে নিরুপমা। যুবকটি আশেপাশে উঁকি দিচ্ছে শিশুর মতো। পরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিছু খায়, কথা হয়। এরপর কাজ শেষে নিরুপমা বই হস্তান্তর করে, যুবক তখনো সাথে।

নিরুপমা চটে গিয়ে বলে, "আপনার তো যাওয়ার কথা ছিল টি.এস.সি পর্যন্ত!" সে নির্বিকারভাবে বলে, "বসতে না আসলেই কি বসা যাবে না?"

শেষপর্যন্ত নিরুপমা রাগে বলে, "চুপচাপ চলুন নয়তো আমি চলে যাবো।"

যুবকটি বাধ্য ছেলের মতো পিছু নেয়, কিন্তু প্রশ্ন থামে না।

এই অচেনা, অতিসচেতন, মায়া-মাখা যুবকটির উপস্থিতি যেন ধীরে ধীরে নিরুপমার মনে এক অজানা চিহ্ন এঁকে দেয়। সে আর জানে না, এ অনুভূতির নাম কী। তবে জানে, বৃষ্টি মানে শুধু ভেজা শরীর নয়, কখনো কখনো অদ্ভুত এক ভিজে যাওয়া মন। আর আজকের এই বৃষ্টির দিনে, সেই মনটা ভিজে গেছে এক চেনা-অচেনা অনুভবের আদরে।


এই লেখাটির পেছনে আছে এক অনুরণন: কখনো কখনো, অচেনা কারও ভেতরে পাওয়া যায় অদ্ভুত রকম এক চেনা ভাব। আর তখনই বোঝা যায়—বৃষ্টি মানে তুমি