রাগ নিয়ন্ত্রণের উপায়

প্রকাশকালঃ ১৩ জুলাই ২০২৪ ০৪:১২ অপরাহ্ণ ২৭৪ বার পঠিত
রাগ নিয়ন্ত্রণের উপায়

আনন্দ, দুঃখ, বিরক্তি, ভয়, বিস্ময়ের মতো রাগও মানুষের মৌলিক একটি আবেগ। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মাঝেমধ্যে রাগ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু রাগের প্রকাশ যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখনই ঘটে বিপত্তি। যারা শৈশব-কৈশোর থেকেই অল্পতে রেগে যান এবং সেটির অস্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ ঘটান, তাদের অন্যরা রগচটা বা বদরাগী মানুষ হিসেবে চেনে।


অনিয়ন্ত্রিত রাগের প্রভাব

রেগে গেলে ব্যক্তির সাধারণ জ্ঞান, নম্রতা, ভদ্রতা বোধ ও লজ্জা-সংকোচ লোপ পেতে পারে, ব্যক্তি আক্রমণাত্মক হয়ে ঘটাতে পারেন যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা। এতে ব্যক্তির নিজের বা অন্যের ক্ষতি হতে পারে। রাগের অনিয়ন্ত্রিত বহিঃপ্রকাশে জীবনযাপনের স্বাভাবিক দক্ষতা যেমন হ্রাস পেতে পারে, পারস্পরিক সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হতে পারে, তেমনি বড় ধরনের শারীরিক ক্ষতি থেকে মৃত্যুও হতে পারে।

 

রাগের অনিয়ন্ত্রিত বহিঃপ্রকাশের কারণ

♦ নিউরোসায়েন্টিস্ট ও সাইকো অ্যানালিসিসের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তিগুলোর একটি হচ্ছে নিজের প্রতি ধ্বংসাত্মক মনোভাব। কিন্তু তা নিজের জন্য ক্ষতিকর বিধায় অবচেতনে এই প্রবৃত্তির বিপক্ষে আত্মরক্ষামূলক আচরণ হিসেবে মানুষ অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়।

♦ সাইকোলজিস্ট আলবার্ট বান্দুরার ‘সোশ্যাল লার্নিং’ মতবাদ অনুযায়ী, পরিবেশ ও সমাজ থেকেই ব্যক্তি অনিয়ন্ত্রিত রাগের প্রকাশ শেখে। রাগ দেখালে ব্যক্তি যদি কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হয় বা ফল লাভ করে, অন্যরা ব্যক্তির ইচ্ছা পূরণ করে বা তাকে সমীহ করে—তাহলে পরবর্তী সময়ে রাগ দেখিয়েই কাজ উদ্ধারে উদ্বুদ্ধ হয় সেই ব্যক্তি। আবার অনেক সময় ওই ব্যক্তিকে দেখে অন্যরাও একই ধরনের আচরণ করতে উৎসাহিত হয়।

♦ সাইকোলজিস্ট জন ডোলার্ড-এর ‘ফ্রাস্ট্রেশন-অ্যাগ্রেশন হাইপোথিসিস’ অনুসারে, মানুষের লক্ষ্য পূরণে বাধা বা নিষ্ফলতা ও ব্যর্থতা থেকে তৈরি হওয়া হতাশারই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে রাগের প্রকাশ।

♦ সাইকোলজিস্ট ক্রেইগ অ্যান্ডারসন এবং ব্রাড বুশম্যানের ‘জেনারেল অ্যাগ্রেশন মডেল’ অনুযায়ী, ব্যক্তিগত, পারিপার্শ্বিক, সামাজিক, জৈবিক ও মানসিক বিষয়াবলির মিথস্ক্রিয়ায় রাগ ও এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ব্যক্তি কোনো কারণে মানসিক চাপে থাকলে, দৈনন্দিন নানা চাপের মোকাবেলায় অসমর্থ হলে বা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের মধ্যে দিন যাপন করলে উপেক্ষণীয় ঘটনাতেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন বা রেগে যেতে পারেন।

 

মানসিক রোগীর ক্ষেত্রে রাগ

ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক, নিরোগ মানুষও যেমন রেগে যেতে পারেন এবং এর অস্বাভাবিক প্রকাশ ঘটাতে পারেন, তেমনটি ঘটতে পারে যেকোনো মানসিক রোগীর ক্ষেত্রেও। কিছু মানসিক রোগীর বেলায় রাগ নিয়ন্ত্রণে দক্ষতার অভাব দেখা যায়। আবার কখনো কখনো আত্মীয় বা অন্যরা বুঝে বা না বুঝে রোগীকে রাগিয়ে দেয়। সিজোফ্রেনিয়া জাতীয় রোগে আক্রান্তরা সন্দেহের বশে বা তাঁদের ভুল বিশ্বাসের ফলে কাউকে শক্র ভেবে রেগে যেতে এবং সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন।

 

ম্যানিয়ায় আক্রান্তদের কথা-কাজে বাধা দিলে বা তাঁদের মতের বিরুদ্ধে গেলে রেগে যেতে পারেন। মাদকের প্রভাবে ব্যক্তি হঠাৎ রাগী আচরণ করতে পারেন। বিষণ্নতা ও অতি উদ্বেগজনিত রোগীরাও কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণহীন রাগে ফেটে পড়তে পারেন। অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিস-অর্ডার, বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিস-অর্ডারের মতো ব্যক্তিত্বের ত্রুটিজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।

 

রাগ নিয়ন্ত্রণে

রাগ নিয়ন্ত্রণ বলতে মূলত রাগের অস্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করাকেই বোঝায়। এ জন্য কী কারণে, পরিস্থিতিতে বা ঘটনায় রাগ ওঠে তা বুঝতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিবার রাগ হওয়ার পর এর কারণ এবং ওই সময়ে শারীরিক-মানসিক অনুভূতি ও ভাবনা ডায়েরিতে লিখে রাখতে হবে। রাগ ওঠার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বা রাগ উঠলে তাৎক্ষণিক সেখান থেকে সরে যেতে পারলে ভালো। সম্ভব না হলে ওই সময় চুপ থাকা উচিত। রাগের মাথায় যা বলা হয় তা অপ্রীতিকর এবং অযৌক্তিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

 

কথা না বলে বরং ইতিবাচক কোনো কিছু ভাবা বা আনন্দদায়ক স্মৃতি রোমন্থন করা যেতে পারে বা অন্য কিছুতে ব্যস্ত হওয়া যেতে পারে। মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়োটাই মূল লক্ষ্য। সবচেয়ে জরুার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো। কোনো ঘটনার ইতিবাচক দিক দেখার মানসিকতা গড়ে উঠলে হুটহাট রেগে যাওয়ার প্রবণতা কমে। মানসিক রোগের কারণে হঠাৎ করে অনিয়ন্ত্রিত রাগের সমস্যা দেখা দিলে সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে।