ইসলাম আত্মপ্রকাশের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তথা ৬৪১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মুসলিমরা মিসর ও শাম জয় করে, যা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। এর এক বছর পর মুসলিম বাহিনী সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বড় জয় পায়। এ সময় তারা মধ্য এশিয়ার আমু দরিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং প্রথমবারের মতো তুর্কি জাতি-গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়। তবে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের আগ পর্যন্ত তুর্কিদের সঙ্গে মুসলিমদের সম্পর্ক সীমান্তবর্তী প্রতিবেশীতেই আটকে থাকে।
কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন, ৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি ও উমাইয়া প্রশাসক উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের আহ্বানে একদল তুর্কি ইসলাম গ্রহণ করে ইরাকে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইরাকের প্রশাসক নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি পূর্বাঞ্চলে জয়ে মনোযোগী হন। ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিখ্যাত সেনাপতি কুতাইবা বিন মুসলিমকে খোরাসান অভিযানে প্রেরণ করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে মুসলিম বাহিনী মাওরাউন নাহার (Transoxiana) অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়।
অবশ্য তুর্কিরা তখন মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ৭৫১ খ্রিস্টাব্দে তালাস নদীর তীরে, যা বর্তমান কিরগাস্তানে অবস্থিত চীনাদের সঙ্গে মুসলিমদের লড়াই হয়। এই যুদ্ধে তুর্কিরা চীনের পক্ষে অস্ত্রধারণ করে। তবে এই যুদ্ধ তুর্কি ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তারা কাছ থেকে মুসলমানদের দেখার এবং তাদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পায়। ফলে তুর্কিদের ভেতর দ্রুত ইসলাম বিস্তার করতে থাকে এবং সময়ের পরিক্রমায় প্রায় সব তুর্কি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
তুর্কিদের ইসলাম গ্রহণের কারণ
ঐতিহাসিকরা তুর্কিদের দ্রুত ইসলাম গ্রহণের কিছু কারণ নির্ধারণ করেছেন। যার কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলো :
১. ধর্মীয় কারণ : বেশির ভাগ তুর্কি ‘গৌক তানরি’র প্রতি বিশ্বাসী ছিল। তাদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের অনেক মিল ছিল। যেমন তারা বিশ্বাস করত ঈশ্বর একজন, শয়তানের অস্তিত্ব আছে, রুহ অবিনশ্বর, পরকাল আছে, জান্নাত-জাহান্নাম আছে। ইসলামের মতো তাদের ধর্মেও মিথ্যা, চুরি, ব্যভিচার, হত্যা ও অবিচার হারাম ছিল। তারা পশু কোরবানি করত, নিজ খোদার সেজদা করত এবং একাধিক স্ত্রী রাখা বৈধ মনে করত। ইসলাম গ্রহণের আগেও তুর্কিরা কখনো শূকরের মাংস খায়নি এবং তা পালন করেনি। ইসলামের প্রতিরক্ষানীতি ও দ্বিন প্রচারের স্পৃহার সঙ্গে তাদের ‘যোদ্ধাপ্রকৃতির’ মিল ছিল।
২. অর্থনৈতিক কারণ : মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্তান অঞ্চল জয় করার পর মুসলমানদের সঙ্গে তুর্কিদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষত প্রাচীন সিল্করোডের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অনন্য। সিল্করোড ধরে মুসলিম বণিকরা মধ্য এশিয়ায় এবং তুর্কিরা আরবে গমন করত। বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও লেনদেন তাদের ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।
৩. সামাজিক কারণ : মুসলিমরা তাদের নৈতিকতা, ব্যবসায়িক সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ইত্যাদি চারিত্রিক গুণের মাধ্যমে বিজিত অঞ্চলের তুর্কিদের প্রভাবিত করে। তুর্কিরা যখন বুঝতে পারল ইসলাম মুসলমানদের ভেতর এই গুণাবলি সৃষ্টি করেছে, তখন তারা ইসলামের অনুরাগী হয়ে ওঠে। যেমন মুসলিম ব্যবসায়ীরা কাপড় বিক্রির সময় তা ঢিলা করে আর কেনার সময় টেনে পরিমাপ করত। বিষয়টি তুর্কিদের মুগ্ধ করেছিল।
৪. রাজনৈতিক ও সামরিক কারণ : উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফারা তুর্কি সেনাদের বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতেন। তারা তুর্কিদের নিয়ে সেনাবাহিনীর বিশেষ শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি আব্বাসীয় খলিফারা তুর্কি সেনাদের জন্য সামারার সামরিক শহর তৈরি করেছিলেন। সামরিক নেতৃত্বের পাশাপাশি তুর্কিরা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদগুলোতেও অধিষ্ঠিত হন, যা তাদের ইসলাম গ্রহণে উৎসাহিত করেছিল।
তুর্কি শাসকদের ইসলাম গ্রহণ : তুর্কি জাতি-গোষ্ঠী ব্যাপকভাবে মুসলিম হয়েছিল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দশম খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। এর একটি কারণ ছিল তুর্কি গোত্রপতি ও শাসকদের ইসলাম গ্রহণ। প্রথম তুর্কি শাসক হিসেবে ৭০৪ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম গ্রহণ করে আমির নেজাক তারহান। তিনি মধ্য এশিয়ার তুহারিস্তান নামক অঞ্চল শাসন করতেন। সেনাপতি কুতাইবা বিন মুসলিমের সঙ্গে তিনি একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
ভলগা নদীর তীরে বাসকারী ভলগার তুর্কিরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয় যখন তাদের শাসক ইলতিবার আলমিশ খান মুসলিম হন। ৯২০ সালে ইসলাম গ্রহণের পর তিনি জাফর নাম ধারণ করেন। প্রথম তুর্কি সম্রাট হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেন সুলতান সাতুক বুগরা খান। তিনি কারখানাতে শাসক ছিলেন। তিনি ২৫ বছর বয়সে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারেন। তখন তিনি আরতুশ অঞ্চলের গভর্নর ছিলেন। ৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন এবং আবদুল করিম নাম ধারণ করেন। এ সময় বিপুলসংখ্যক তুর্কি ইসলাম গ্রহণ করে।