ঢাকার ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লার রহস্যঘেরা সুড়ঙ্গ দীর্ঘদিন ধরে মানুষের কল্পনা ও কৌতূহলকে উদ্দীপ্ত করে আসছে। এই সুড়ঙ্গগুলির ভেতর কী আছে তা নিয়ে নানা গল্প, রহস্য ও কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
প্রখ্যাত মুঘল ঐতিহ্য নিয়ে ঢাকায় এখনো টিকে আছে লালবাগ কেল্লা। তবে আগের সেই কারুকাজ ও সৌন্দর্য কিছুটা মলিন হয়ে এলেও আজও এই দুর্গ নিয়ে এই জনপদের মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র আজম শাহ (পরবর্তীতে নিজেও যিনি সম্রাট পদপ্রাপ্ত হয়েছিলেন) এই দুর্গের নির্মাণকাজ প্রথম শুরু করেন ১৬৭৮ সালে। পরবর্তীতে বাংলার সুবাদার হিসেবে শায়েস্তা খাঁ, আজম শাহের অনুরোধে এই দুর্গের কাজ আবার শুরু করেন। কিন্তু ১৬৮৪ সালে তাঁর অতি আদরের মেয়ে ইরান দুখত রাহমাত বানু ওরফে পরী বিবির আকস্মিক মৃত্যু হয়।
এ ঘটনাকে তিনি অশুভ মনে করে দুর্গের প্রায় ১২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করে নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেন এবং শেষ পর্যন্ত এটির নির্মাণকাজ অসম্পূর্ণই থেকে যায়। প্রথমে এর নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ। পরে লালবাগ দুর্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গের প্রাচীর সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়। অবশেষে নির্মাণের ৩০০ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের যথাসম্ভব সংস্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনা হয় এবং দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
সুড়ঙ্গ নিয়ে রহস্যের শুরু যেভাবেঃ
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময়কার বিদ্রোহী সিপাহীদের ব্রিটিশরা ধরে ধরে ফাঁসি দিতে থাকে। সেই সময় কয়েকজন বাঙ্গালি সৈনিককে তাড়া করতে গেলে ওই সৈনিকরা লালবাগ কেল্লার মূল সুড়ঙ্গ দিয়ে পালাবার চেষ্টা করে, তাদের ধরতে আরও কয়েকজন ব্রিটিশ সৈন্য তাদের পিছু নেয়। কিন্তু কেউই আর ফিরে আসেনি। এই ঘটনা তদন্তে ব্রিটিশরা প্রথমে শেঁকল বেঁধে দুটি কুকুর পাঠায় এবং পরে আরও দুইটি।কিন্তু চারটি কুকুরের সাথে বেঁধে দেওয়া শেকলগুলোই শুধু ফেরত আসলেও কুকুরগুলো আর ফিরে আসেনি।(অনেক জায়গায় এ নিয়ে মতবিরোধ আছে)। এরপর তারা ঐ সুড়ঙ্গের মুখ লোহার শেঁকল দিয়ে বেঁধে বন্ধ করে দেয়।
আবার লোকমুখে শোনা যায়, এই সুড়ঙ্গ দিয়ে পাশেই বুড়িগঙ্গা নদীতে যাওয়া যেত। সুড়ঙ্গমুখ থেকে বেরিয়েই নৌকায় উঠে যাওয়া যেত জিঞ্জিরা প্রাসাদে। আবার নদীর বাতাস অনুভবের জন্য ওই সময়ের সেনাপতিরা এই সুড়ঙ্গ ব্যবহার করতেন। তবে এসব কথাকে কল্পকাহিনী বলে দাবি করেছে লালবাগ কেল্লার কাস্টোডিয়ান কার্যালয়। এখানকার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এসব কথার কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে যুদ্ধের সময় মুঘল সেনারা যখন বুঝতেন পরাজয় কাছাকাছি, তখন তারা এই সুড়ঙ্গ দিয়ে দুর্গের দেয়াল পেরিয়ে যেতেন। সুড়ঙ্গপথের রহস্য উদঘাটনের জন্য আজ পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ হয়নি। তাই এটি ঢাকার আদি বাসিন্দাদের কাছে এক বিরাট রহস্য। আজও এই সুড়ঙ্গের সামনে তারা জড়ো হয়ে দাঁড়ান। সাধারণের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় বা কৌতূহলবশত কেউ যাতে এর ভিতরে প্রবেশ না করে, সে জন্য সুড়ঙ্গমুখে ফটক নির্মাণ করে তাতে তালা দেওয়া হয়েছে।
কি লুকিয়ে আছে ঐ বদ্ধ দরজার ওপারে তা এখনো মানুষের জানা নেই। তবে সব মিলিয়ে লালবাগ কেল্লা শুধু ইতিহাসেরই না, বরং রহস্যেরও আধার বটে।