ভিজিএফের হতদরিদ্রের তালিকায় ১৮৪০ শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও সচ্ছল পরিবার

  প্রিন্ট করুন   প্রকাশকালঃ ১৫ জুন ২০২৫ ০১:৩৪ অপরাহ্ণ   |   ৩৯ বার পঠিত
ভিজিএফের হতদরিদ্রের তালিকায় ১৮৪০ শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও সচ্ছল পরিবার

আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-

 


কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ৮ নং বলদিয়া ইউনিয়নে ঈদুল আজহা উপলক্ষে হতদরিদ্র মানুষের জন্য ভিজিএফ প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ দেওয়া তালিকা প্রস্তুত ও চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। তালিকায় দরিদ্রদের পরিবর্তে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীসহ এক হাজার ৮০০ সচ্ছল ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

 

 

জনপ্রতিনিধি ও তালিকা অনুমোদন কমিটির যোগসাজশে চাল আত্মসাতের জন্য দরিদ্রদের বাদ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সচ্ছলদের নাম দিয়ে তালিকা করা হয়েছে বলে অভিযোগ ‍করেছেন স্থানীয় লোকজন।

 

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, এসব নামের বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া স্লিপ চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ব্যবসায়ীদের কাছে আগেই বিক্রি করে দেন। তবে এবার ঈদে বিতরণের সময় স্থানীয় সচেতন লোকজন বাধা দেওয়ায় এসব স্লিপের চাল তুলতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। এতে ঈদুল আজহার আগের দিন বিতরণ শেষে গুদামে থেকে যায় প্রায় সাড়ে ১৮ মেট্রিক টন চাল। তবে ঈদুল ফিতরে একই তালিকায় চাল বিতরণ শেষ করা হয়েছিল। সেসময় ওই সাড়ে ১৮ মেট্রিক টন চাল কারা নিয়েছেন, তা তদন্ত করে দেখার কথা বলেছেন তারা।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ৮নং বলদিয়া ইউনিয়নে ঈদুল আজহা উপলক্ষে পাঁচ হাজার ৭৪৫ জন হতদরিদ্র মানুষের জন্য ১০ কেজি করে ৫৭ দশমিক ৪৫ মেট্রিক টন চল বরাদ্দ দেয় সরকার। তালিকা প্রস্তুত করেন সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়াম্যান ও মেম্বাররা। পরে উপজেলা কমিটি যাচাই-বাছাই করে তালিকা অনুমোদন দেয়। তবে ইউনিয়নের হতদরিদ্র মানুষের নাম বাদ দিয়ে এক হাজার ৮০০ সচ্ছল ব্যক্তির নাম দেওয়া হয়। যেখানে চাকরিজীবীদের নামও রয়েছে। তালিকা যাচাইয়ে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সঙ্গে যাচাই-বাছাই কমিটির ব্যক্তিদের যোগসাজশে এ অনিয়ম করা হয়। 

 

তালিকায় অনিয়মের সত্যতা স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসন। এ অবস্থায় তালিকা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। তবে পরিবর্তিত তালিকা তৈরি করতেও অনিয়মের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন ও দরিদ্ররা।

 

স্থানীয় লোকজন ও দরিদ্ররা বলছেন, গত ঈদুল ফিতরে তালিকা নিয়ে অনিয়ম প্রকাশ হলে এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে বরাদ্দকৃত চাল বিতরণে আবারও তালিকার অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ তোলে সচেতন মহল। পরে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নামের সঙ্গে স্লিপ প্রাপ্ত মানুষকে মিলিয়ে চাল বিতরণ করে প্রশাসন। এতে বেরিয়ে আসে তালিকায় থাকা এক হাজার ৮০০ সচ্ছল ব্যক্তির নাম। তবে এসব ব্যক্তি চাল গ্রহণ করতে উপস্থিত হননি। পরে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সাড়ে ১৮ মেট্রিক টন চাল ইউনিয়ন পরিষদের গুদামে সিলগালা করে রাখা হয়। ধারণা করা হচ্ছে এসব তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের স্লিপের চাল তাদের অগোচরে চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে প্রশাসনের নজরদারিতে তা ব্যর্থ হয়।

 

তালিকা যাচাই করে দেখা গেছে, তালিকায় ১১৩৮ নম্বরে রয়েছেন স্বপন কুমার সরকার। তিনি বলদিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ২৯২১ নম্বরে রয়েছেন রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী, ২৯৩৯ নম্বরে আছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা লুৎফর রহমান, ২৯৪৯ নম্বরে রয়েছেন সচ্ছল ব্যক্তি আইনুল হক, ২৫৭ নম্বরে রয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আশরাফুজ্জামান, ২৫৮ নম্বরে আছেন প্রাথমিকের আরেক শিক্ষক আরমান আলী। এভাবে এক হাজার ৮০০ সচ্ছল ব্যক্তির নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

 

তবে তালিকাভুক্ত সচ্ছল ব্যক্তি ও চাকরিজীবীদের দাবি, তারা জানেন না, তাদের নাম কারা কীভাবে এই তালিকায় দিয়েছেন।

 

শিক্ষক আরমান আলী ও আশরাফুজ্জামান বলেন, আমরা জানি না কীভাবে আমাদের নাম ভিজিএফের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তালিকায় নাম দিয়ে আমাদের সামাজিকভাবে হেয় করা হয়েছে।

 

তালিকায় নিজের নাম দেখে হতভম্ব হয়েছেন ওই ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, ‘কারা আমার নাম তালিকাভুক্ত করেছেন, জানা নেই। তবে শুনেছি, এসব নাম দিয়ে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা চাল বিক্রি করে দেন। তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।’ 

 

ঈদুল আজহার আগের দিন ৬ জুন ইউনিয়ন পরিষদে হাজারো হতদরিদ্র নারী-পুরুষ চাল নিতে এসে সারাদিন অপেক্ষা করে সন্ধ্যায় খালি হাতে ফিরে যান। এদের অনেকে ঈদুল ফিতরে চাল পেলেও এবার পাননি।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এই তালিকা দিয়ে ঈদুল ফিতরে চাল বিতরণ করা হয়েছিল। এবারও একই তালিকা দিয়ে চাল বিতরণ করা হয়েছে। তালিকায় ভুলক্রমে কিছু সচ্ছল ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে স্লিপ বিক্রির অভিযোগ সত্য নয়।’

 

এ ব্যাপারে ইউনিয়নে চাল বিতরণের দায়িত্বে থাকা ট্যাগ কর্মকর্তা ও ভূরুঙ্গামারী পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘বিতরণের শেষ দিনে এক হাজার ৮৪০ জন তালিকাভুক্ত ব্যক্তি চাল নিতে আসেননি। এসব ব্যক্তির বিপরীতে প্রায় সাড়ে ১৮ মেট্রিক টন চাল গুদামে রেখে সিলগালা করে রাখা হয়েছে।’

 

চাল বিতরণের তালিকা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ গোলাম ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘তালিকা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় চাল বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তালিকা সংশোধন করে অবশিষ্ট চাল বিতরণ করা হবে।’