প্যানিক অ্যাটাক সাধারণত প্রাণঘাতী না হলেও অসুস্থ ব্যক্তি অমানবিক কষ্টে ভোগেন, যা তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেলতে পারে মারাত্মক প্রভাব। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে বিশ্বে প্রায় ১ শতাংশ মানুষ প্যানিক ডিস-অর্ডারে ভুগছে। আবার প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ তার জীবনকালে দু-একবার প্যানিক অ্যাটাকের মধ্য দিয়ে গেছে।
প্যানিক অ্যাটাক কী?
প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে সেই পরিস্থিতি, যখন হঠাৎ করে আমাদের একই সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক উদ্বিগ্নতার তীব্র উপসর্গ দেখা দেয় এবং যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচণ্ড ভীত হয়ে পড়েন।
প্যানিক ডিস-অর্ডার ও প্যানিক অ্যাটাক একই বিষয় নয়। প্যানিক ডিস-অর্ডারের মধ্যে বারবার প্যানিক অ্যাটাক হতে থাকে। প্যানিক ডিস-অর্ডারে ভবিষ্যতে আরো অনেক অ্যাটাক হওয়ার একটি ক্রমাগত ভয় থাকে এবং সাধারণত যেসব ঘটনা প্যানিক অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলতে পারে অথবা বিগত দিনের প্যানিক অ্যাটাকগুলোকে মনে করিয়ে দিতে পারে, রোগী সেগুলোকে এড়িয়ে যেতে থাকে।
কিভাবে বুঝবেন প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে
প্যানিক অ্যাটাক হঠাৎ করেই শুরু হয়। ১০ মিনিটের মধ্যে তীব্র উপসর্গ দেখা দেয়। উপসর্গগুলো নানা রকমের হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিম্নের চার বা ততোধিক উপসর্গ দেখা দেয়—
শারীরিক উপসর্গ
বুক ধড়ফড় করা/হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, প্রচণ্ড ঘাম হওয়া, সারা শরীরে কম্পন অনুভূত হওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, দম আটকে আসা, বুকে ব্যথা হওয়া বা বুকে প্রচণ্ড চাপ অনুভূত হওয়া, মাথা ঘোরা, আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া, বোধশক্তি লোপ পাওয়া, শরীর অসাড় হয়ে যাওয়া বা শিরশির করা এবং মাথা ব্যথা।
মানসিক উপসর্গ
মৃত্যুভয়, তীব্র আতঙ্ক, তীব্র হতাশা, মনে হয় যেন নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে, নিজের শরীর থেকে আলাদা হয়ে নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন এমন অনুভূতি হতে পারে, ডি-রিয়ালাইজেশন বা আশপাশের সব কিছু অবাস্তব মনে হওয়া।
কখন হয়?
প্যানিক অ্যাটাক যেকোনো সময় হঠাৎ করে হতে পারে। এর সময়কাল মানুষভেদে বিভিন্ন হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি ২০ থেকে ৩০ মিনিট স্থায়ী হয় এবং সাত থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত তীব্র পর্যায়টি চলে। এই পরিস্থিতিগুলো একজন ব্যক্তির স্বপ্ন বা চিন্তা-ভাবনায়ও আসতে পারে। আতঙ্কের অনুভূতি, অসহায়তা এবং ভয়ের মাধ্যমে এই পরিস্থিতিগুলো আবার অনুভব করে থাকেন।
কেন হয়?
প্যানিক অ্যাটাকের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে বিভিন্ন গবেষণায় বিভিন্ন রিস্ক ফ্যাক্টরের কথা বলা হয়েছে এবং বিশ্লেষণ করা হয় যে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র একটি প্রদত্ত পরিস্থিতিতে উদ্বেগ অথবা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া বারবার প্যানিক অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় এমন কিছু কারণ হলো—
♦ মানসিক রোগ, যেমন—ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ডিস-অর্ডার, পারসোনালিটি ডিস-অর্ডার ইত্যাদি।
♦ পারিবারিক ইতিহাস বা জেনেটিক্যাল কারণ।
♦ অতিরিক্ত ধূমপান, মাদকাসক্তি।
♦ খুব বেশি সময় হতাশা বা খারাপ সময় পার করলে।
♦ অতীতের কোনো যৌন হয়রানি/শারীরিক নির্যাতনের ইতিহাস থাকলে।
♦ বংশপরম্পরায় কোনো মানসিক ব্যাধির ইতিহাস থাকলে।
প্যানিক অ্যাটাক হলে যা করবেন
♦ আপনার সামনে কারো এমন হলে তাঁকে নিরাপদ ও আরামদায়ক স্থানে বসান।
♦ আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঠাণ্ডা পানি পান করান এবং চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিন, তাতে শান্ত হবে তাঁর স্নায়ুতন্ত্র।
♦ শিথিলায়ন পদ্ধতি জানা থাকলে তাঁকে সেটি করান অথবা শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে বলুন।
♦ উদ্বেগ থেকে সরানোর জন্য তাঁর মনকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করুন। এ ক্ষেত্রে গ্রাউন্ডিং পদ্ধতি বেশ কার্যকর। এই পদ্ধতিটি হলো : ৫-৪-৩-২-১ এভাবে হয়। অর্থাৎ তাঁকে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করুন কোন পাঁচটি বস্তু তিনি দেখতে পাচ্ছেন? তারপর জিজ্ঞেস করুন কোন চারটি জিনিস তিনি ছুঁতে পারছেন? তারপর কোন তিনটি আওয়াজ তিনি শুনতে পাচ্ছেন? এরপর কোন দুটি জিনিসের গন্ধ নিতে পারছেন? সর্বশেষ প্রশ্নটি হলো কোনটির স্বাদ তিনি নিতে পারছেন? এভাবে একে একে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তির উদ্বেগ দূর করুন। আর যদি পরিস্থিতি বেশি খারাপ মনে হয়, তাহলে দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়াই উত্তম।
নিয়ন্ত্রণের উপায়
প্যানিক অ্যাটাক যেহেতু বেশি সময় স্থায়ী হয় না, মনে জোর নিয়ে ধৈর্যধারণই প্রাথমিক সমাধান। এ ক্ষেত্রে সেলফ হেল্প পদ্ধতি বেশ কার্যকর। তা ছাড়া কিছু কাজ প্যানিক অ্যাটাকের তীব্রতা ও সময় দুটিই কমিয়ে আনতে পারে। যেমন—
মানসিক প্রস্তুতি: রোগীকে ভালোভাবে মাথায় গেঁথে রাখতে হবে যে এই প্যানিক অ্যাটাক তাঁর কোনো শারীরিক রোগ নয়, এটি মানসিক রোগ। এতে মৃত্যুর কোনো আশঙ্কা নেই। কিছুক্ষণ পর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।
শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম: প্রতিদিন রুটিন করে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে এবং যখন প্যানিক অ্যাটাক হবে, তখনো এই ব্যায়াম করতে হবে। এতে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। তা ছাড়া এতে মস্তিষ্কে যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন পৌঁছালে অ্যাটাকের তীব্রতা কমে যাবে।
মাসেল রিলাক্সেশন পদ্ধতি: প্যানিক অ্যাটাকের সময় মনে হয় রোগী তাঁর শরীরের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে চলেছেন। তখন মাংসপেশির সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে শিথিলায়ন পদ্ধতি চর্চা করলে শরীরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
মনোযোগ ঘোরানোর চেষ্টা করতে হবে: যখনই মনে হবে প্যানিক অ্যাটাক হতে চলেছে, ওপরে উল্লিখিত কাজগুলোর পাশাপাশি নিজের মনকে অন্যদিকে ঘোরাতে হবে। আগে উল্লিখিত গ্রাউন্ডিং পদ্ধতি ছাড়াও ওই মুহূর্তে কোনো অনুপ্রেরণামূলক গান গাওয়া যেতে পারে অথবা পাশে কেউ থাকলে তার সঙ্গে জোরে জোরে কথা বলা যেতে পারে। ছোটবেলার কোনো ভালো স্মৃতি মনে করা যেতে পারে, আশপাশে কী ঘটছে মনোযোগ দিয়ে দেখা যেতে পারে, ফ্লোরের টাইলস গোনার মতো কাজগুলো করা যেতে পারে ইত্যাদি।
♦ নিয়মিত ব্যায়াম করা।
♦ উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করা।
♦ ধূমপান, ক্যাফেইন ও মাদক পরিহার করা।
♦ স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন স্বাস্থ্যকর রুটিন, পর্যাপ্ত ঘুম ইত্যাদি।
চিকিৎসা
সাইকিয়াট্রিস্টরা কিছু ওষুধ দেন এবং সাইকোথেরাপিস্টরা সাইকোথেরাপির মাধ্যমে প্যানিক অ্যাটাকের চিকিৎসা করে থাকেন। এর ভেতর Cognitive behavioral therapy (CBT) সবচেয়ে কার্যকর বলে প্রমাণিত। এই থেরাপিতে থেরাপিস্টরা শান্ত হওয়ার ট্রেনিং দেন এবং চিন্তা নিয়ন্ত্রণ ও মনের শক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেন।
লেখক : সাইকিয়াট্রিস্ট, অ্যাডিকশন অ্যান্ড সেক্সুয়াল হেলথ স্পেশালিস্ট