আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় যে শহর

প্রকাশকালঃ ০৮ মে ২০২৩ ০১:০৬ অপরাহ্ণ ১৭০ বার পঠিত
আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় যে শহর

প্রখ্যাত তাবেঈন হাসান বসরি (রহ.) একজন বিশিষ্ট বুজুর্গ ছিলেন, আধ্যাত্মিক সাধনা ও আল্লাহভীতি অতুলনীয় ছিলেন, সাধারণ ও বিশেষ উভয়ে শ্রেণিতে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন, পঠন-পাঠন ও বাগ্মিতায়ও তাঁর সুখ্যাতি ছিল। তিনি ২১ হিজরিতে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১০ হিজরি রজব মাসে ইন্তেকাল করেন। তাঁর জীবনের অর্জন সুবিশাল। তাঁর ওয়াজ-নসিহত, ফিকহি মতামত ও ফাতাওয়ার উদ্ধৃতিতে ইসলামী গ্রন্থগুলো ভরপুর।

হাসান বসরি (রহ.) যখন জানতে পারলেন তাঁর একজন প্রিয়ভাজন মক্কা ছেড়ে ইয়ামানে পাড়ি জমানোর ইচ্ছা করেছেন, তখন তিনি তাঁর উদ্দেশে পবিত্র মক্কার মর্যাদা এবং সেখানে অবস্থানের গুরুত্ব ও বরকত সম্পর্কে আলোচনা করেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রিয়ভাজনকে মক্কা ছেড়ে যেতে নিষেধ করেন এবং সেখানে অবস্থানের উপদেশ দেন। হাসান বসরি (রহ.)-এর দীর্ঘ আলোচনার সংক্ষিপ্ত রূপ নিম্নে তুলে ধরা হলো।

তিনি বলেন, হে প্রিয়, মহান আল্লাহ মক্কাকে পৃথিবীর সব শহর ও নগরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। কোরআনে বারবার তার আলোচনা এনেছেন। এক স্থানে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা বাক্কায়, তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারি। তাতে আছে বহু সুস্পষ্ট নিদর্শন। যেমন মাকামে ইবরাহিম। আর যে কেউ সেখানে প্রবেশ করে সে নিরাপদ।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৬-৯৭)


অন্য আয়াতে মক্কানগরীর জন্য ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়ার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। তিনি দোয়া করেন, ‘স্মরণ কোরো, যখন ইবরাহিম বলেছিলেন, হে আমার প্রতিপালক, এটাকে নিরাপদ শহর কোরো। আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে তাদের ফলমূল দ্বারা জীবিকা প্রদান কোরো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১২৬)

আল্লাহ পবিত্র মক্কা নগরীকে সমগ্র মানবজাতির জন্য নিরাপদ আশ্রয় করেছেন এবং বায়তুল্লাহকে পবিত্র রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ কোরো, যখন কাবাঘরকে মানবজাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদস্থল করেছিলাম এবং বলেছিলাম, তোমরা মাকামে ইবরাহিমকে নামাজের স্থানরূপে গ্রহণ কোরো। এবং ইবরাহিম ও ইসমাইলকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য আমার ঘরকে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১২৫)

আল্লাহ নিজেকে কাবার রব বা মালিক হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অতএব, তারা ইবাদত করুক এই ঘরের মালিকের। যিনি তাদের ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভয় থেকে তাদের নিরাপদ করেছেন।’ (সুরা কুরাইশ, আয়াত : ৩-৪)


এমন বহু আয়াতে মহান আল্লাহ মক্কার বর্ণনা দিয়েছেন। মক্কার ব্যাপারে যত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে অন্য কোনো শহরের ব্যাপারে তা হয়নি।

কোরআনের আয়াতগুলো বর্ণনা করার পর হাসান বসরি (রহ.) সেসব হাদিস বর্ণনা করেন, যাতে মক্কা ও মক্কায় অবস্থানকারীদের সম্মান ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরতের জন্য বের হচ্ছিলেন, তখন মক্কার একটি ছোট টিলার ওপর দাঁড়িয়ে মক্কার দিকে ফিরে তাকান এবং বলেন, তুমি (মক্কা) আল্লাহর শহরগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় শহর, আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ভূমি, পৃথিবীর বরকতময় ভূখণ্ড। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বাধ্য না করত তবে আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।


অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, পৃথিবীর সর্বোত্তম ও আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ভূমি মক্কা।

আল্লাহর প্রিয় ভূমি বলেই হয়তো মক্কার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠ সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মক্কার মাধ্যমেই ভূপৃষ্ঠ সৃষ্টির সূচনা হয়। অতঃপর তা বিস্তৃতি লাভ করে।’ আর এ জন্যই মক্কাকে ‘উম্মুল কুরা’ বা বসতিগুলোর মা বলা হয়। মক্কার জাবালে আবু কায়েস পৃথিবীর প্রথম পাহাড়। আদম (আ.)-এর সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগ থেকে ফেরেশতারা বায়তুল্লাহর তাওয়াফ শুরু করেছে। আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের জন্য যখনই কোনো ফেরেশতা পৃথিবীতে আগমন করে, সর্বপ্রথম তারা বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করে এবং মাকামে ইবরাহিমে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে। অতঃপর আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন করে।

পৃথিবীতে মক্কা ছাড়া এমন কোনো শহর নেই যেখানে পৃথিবীর সব নবী; এমনকি আল্লাহর সব পুণ্যবান বান্দা (মানুষ ও ফেরেশতা) আগমন করেছেন। মক্কা ছাড়া এমন কোনো শহর নেই, যেখানে এক রাকাত নামাজের প্রতি এক লাখ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। শুধু নামাজ নয়; বরং রোজা, দান-সদকা, কোরআন তিলাওয়াত, জিকিরসহ সব ইবাদতের প্রতিদান এক লাখ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। কিয়ামতের দিন অন্য কোনো ভূমি থেকে হয়তো এত বেশিসংখ্যক নবী-রাসুল, মুত্তাকি, সাদিকিন, নেককার, আলেম, ফকিহ ও ইবাদতকারী উঠবে না, যত বেশিসংখ্যক উঠবে পবিত্র কাবা থেকে। এরা হলো আল্লাহর দরবারে মুক্তিপ্রাপ্ত দল।


পবিত্র কাবা আল্লাহর কাছে এত প্রিয় যে কাবার দিকে ভালোবাসা নিয়ে তাকালেও সওয়াব হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে সওয়াবের আশায় বায়তুল্লাহর দিকে তাকাবে তার পূর্ব-পরের সব পাপ মার্জনা করা হবে। কিয়ামতের দিন সে নিরাপদ হয়ে যাবে।’ কাবাঘরে প্রবেশকারী আল্লাহর অনুগ্রহের ভেতর প্রবেশ করে। সে ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে বের হয়। মক্কা নগরীতে এমন ১৫টি স্থান আছে, যেখানে দোয়া কবুলের আশা করা হয়। ১. কাবাঘরের ভেতর, ২. হাজরে আসওয়াদের কাছে, ৩. রোকনে ইয়েমেনির কাছে, ৪. হাতিমের ভেতর, ৫. মাকামে ইবরাহিমের পেছনে, ৬. মুলতাজিমের কাছে, ৭. জমজম কূপের কাছে, ৮. রোকনে ইয়েমেনি ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে, ৯. সাফা ও মারওয়াতে, ১০. সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে, ১১. মিনাতে, ১২. মুজদালিফায়, ১৩. আরাফাতে, ১৪. মাশআরুল হারামের কাছে, ১৫. মাকামে ইবরাহিমের মধ্যে।

উল্লিখিত ১৫ স্থানে দোয়া কবুল হয়। কোনো দোয়া করলে সাধারণত ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। বান্দা ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করা হয়। সুতরাং এসব স্থানে দোয়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে মক্কা নগরীর বরকত আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং তুমি মক্কা নগরী ত্যাগ কোরো না।

তামিরে হায়াত থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর