বাংলাদেশে প্রায় অর্ধেক জাপানের তুলনায় পণ্য উৎপাদন খরচ
প্রকাশকালঃ
৩১ আগu ২০২৩ ১২:২৬ অপরাহ্ণ ১৮২ বার পঠিত
বাংলাদেশে ব্যবসারত জাপানি কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রায় ৭১ শতাংশই ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। এর মধ্যে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে একেবারেই অসন্তুষ্ট। বাকি প্রায় ৪৫ শতাংশ কোম্পানি জানিয়েছে, তারা ‘কিছুটা অসন্তুষ্ট’।
জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) এক জরিপে এই মতামত দিয়েছে দেশটির কোম্পানিগুলো। গতকাল বুধবার রাজধানীর গুলশানে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল তথ্য তুলে ধরে জেট্রো। এশিয়া ও ওশেনিয়া বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী জাপানি কোম্পানিগুলোর ওপর জরিপটি করা হয়। গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিচালিত এই জরিপে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী ২১৪টি জাপানি কোম্পানি অংশ নেয়।
এদিকে ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্ট হলেও জাপানি কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রায় ৭২ শতাংশই জানিয়েছে, তারা এ দেশে ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী। কারণ, এ দেশে ব্যবসার খরচ এখনো কম।
এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলের ৪ হাজার ৩৯২টি জাপানি কোম্পানি জরিপে অংশ নেয়। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কোন দেশ তাদের প্রথম পছন্দ। জবাবে সাড়ে ৭২ শতাংশ কোম্পানি প্রথম পছন্দ হিসেবে ভারতের নাম উল্লেখ করেছে। এর পরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ। জাপানিদের ব্যবসা সম্প্রসারণের আগ্রহের ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়াও বাংলাদেশের নিচে রয়েছে। বাংলাদেশের বাজারের বর্তমান আকার ও বাজার বড় হওয়ার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা—এ দেশে জাপানিদের বিনিয়োগ আগ্রহ তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছে।
সস্তা শ্রমে পছন্দের শীর্ষে বাংলাদেশ
জরিপে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ব্যবসার পরিবেশের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ কোথায় এবং কেন এগিয়ে রয়েছে। জবাবে জাপানি কোম্পানিগুলো চারটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে পছন্দের তালিকায় রেখেছে। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে সস্তা শ্রম, শ্রমিক ও কর্মচারীর সহজ প্রাপ্তি, বিশেষায়িত জনশক্তি ও প্রকৌশলীর সহজ প্রাপ্তি এবং বিদ্যমান বাজার।
জরিপে ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ জাপানি কোম্পানি ‘সস্তা শ্রমের’ জন্য বাংলাদেশকে ব্যবসার পরিবেশের ক্ষেত্রে শীর্ষে রেখেছে। সস্তা শ্রমের কারণে জাপানিদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দ হলো যথাক্রমে মিয়ানমার ও ফিলিপাইন।
সাধারণ শ্রমিক ও কর্মচারী প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পছন্দের তালিকায় রেখেছে ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ উত্তরদাতা। এ তালিকায় জাপানিদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ফিলিপাইন। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারের আকারের দিক থেকে বাংলাদেশ জাপানিদের কাছে তৃতীয় পছন্দের দেশ। এ ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত ও ইন্দোনেশিয়া। আর বিশেষায়িত শ্রমশক্তি ও প্রকৌশলী প্রাপ্যতার দিক থেকে বাংলাদেশ তাদের তৃতীয় পছন্দ। এ ক্ষেত্রে জাপানিদের প্রথম ও দ্বিতীয় পছন্দ যথাক্রমে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা।
ব্যবসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেখানে খারাপ
জাপানি কোম্পানিগুলো ব্যবসার পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সবচেয়ে পিছিয়ে; অর্থাৎ অপছন্দের শীর্ষে রেখেছে দুটি ক্ষেত্রে। প্রথমটি ব্যবসার অনুমোদন ও সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে দক্ষতার ঘাটতি, দ্বিতীয়টি করব্যবস্থার অদক্ষতা। প্রায় ৮০ শতাংশ জাপানি কোম্পানি মনে করে, এ দেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আর ৭৩ দশমিক ৪ শতাংশ জাপানি কোম্পানি মনে করে, করব্যবস্থার অদক্ষতা ব্যবসার ক্ষেত্রে এ দেশে বড় বাধা। এ ছাড়া বিদেশি মূলধনের আইনি কাঠামো বা ভিত্তি তৈরি এবং বিদেশিদের ভিসা ও কাজের অনুমতি (ওয়ার্ক পারমিট) প্রাপ্তির জটিলতাও বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। যদিও এ দুটি ক্ষেত্রে মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ।
ব্যবসা পরিচালনায় বড় চ্যালেঞ্জ
গত বছর; অর্থাৎ ২০২২ সালে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে জাপানিদের কাছে প্রধান দুটি চ্যালেঞ্জ ছিল শুল্ক ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত জটিলতা ও বৈদেশিক মুদ্রার দামের অস্থিরতা। ২০২১ সালে বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানিগুলোর ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল, দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি ও মজুরি বৃদ্ধি। জরিপে অংশ নেওয়া ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ জাপানি কোম্পানি বলেছে, প্রথম চ্যালেঞ্জ শুল্কায়ন ব্যবস্থার জটিলতা। আর ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ কোম্পানি বৈদেশিক মুদ্রার দামের অস্থিরতাকে ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানায়।
এ ছাড়া ৬৭ দশমিক ৪ শতাংশ জাপানি কোম্পানি স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল কেনার জটিলতাকে, ৬৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সমস্যা ও ৬৩ শতাংশ কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিকে ব্যবসার ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
উৎপাদন খরচ অর্ধেক বাংলাদেশে
সার্বিকভাবে জরিপে জানতে চাওয়া হয়েছিল, পণ্য উৎপাদন খরচ কোন দেশে কেমন। এর জবাবে দেখা যায়, জাপানে যে পণ্য উৎপাদনে খরচ ১০০-তে ১০০, সেখানে বাংলাদেশে সেই পণ্য উৎপাদনে খরচ ৬০ শতাংশের কম। বাংলাদেশের চেয়ে পণ্য উৎপাদনে খরচ কম পড়ে শুধু কম্বোডিয়া ও লাওসে। কম্বোডিয়ায় উৎপাদন খরচ ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ, যা লাওসে ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ। জরিপে অংশ নেওয়া ১৯টি দেশের মধ্যে কম উৎপাদন খরচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।
আলোচনায় যা উঠে এল
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিঞা বলেন, বিদেশিদের কাজের অনুমতিপত্র বা ওয়ার্ক পারমিট যাতে তিন দিনের মধ্যে দেওয়া যায়, সেই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এ ছাড়া ভিয়েতনামের চেয়ে কম সময়ের মধ্যে যাতে ব্যবসা-সংক্রান্ত সেবার অনুমোদন চূড়ান্ত করা যায়, সেই কাজও করছে বিডা।
বিশেষ অতিথি জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি বলেন, জাপানের সঙ্গে সরাসরি বিমান যোগাযোগ শুরুর পর এ দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা হবে। ব্যবসায়ীদের জন্য মাল্টিপল বা বারবার ভ্রমণের জন্য ভিসা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুস সামাদ আল আজাদ বলেন, জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বড়। তাই জাপানে রপ্তানি বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে।
মেট্রো চেম্বারের সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, বাংলাদেশে এখনো কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অনেক ধরনের কাগজপত্র চায়। সময়ও লাগে বেশি, খরচও অনেক দেশের তুলনায় বেশি।
মেট্রো চেম্বারের সভাপতি সায়ফুল ইসলাম শুল্কায়ন জটিলতা কমাতে জাপানি কোম্পানিগুলোকে অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর বা এইও সুবিধা ব্যবহারের আহ্বান জানান।
জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (জেবিসিসিআই) সহসভাপতি মানাবু সুগাওয়ারা বলেন, বিনিয়োগের সম্ভাবনা থাকা মানেই বিদেশি বিনিয়োগ চলে আসা নয়, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে প্রণোদনা দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে জরিপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন জেট্রোর এদেশীয় প্রতিনিধি উজি আন্দো। এতে আরও বক্তব্য দেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের বাণিজ্য ও শিল্প সমিতির সভাপতি টেটসুরো কানো।